নীল বিদ্রোহে শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা
উনিশ শতকের গােড়া থেকেই নীলকরদের অত্যাচার ভয়াবহ হয়ে ওঠে। নীলকরগণ ক্রমশঃ ভয়াবহ হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের তিন, চার ও পাঁচের দশকে নীলকরদের অত্যাচার চরমে ওঠে। এই অত্যাচার এত ভয়ঙ্কর ও দুর্বিষহ হয়ে ওঠে যে কোনাে কোনাে অঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ১৮৫৯ খ্রিঃ বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে যে নীলবিদ্রোহ হয়েছিল তাতে পরােক্ষভাবে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই বিদ্রোহে বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদক, লেখক ও আইনজীবিসহ বিভিন্ন বুদ্ধিজীবিশ্রেণি যথেষ্ট ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।
পত্রিকা সম্পাদকের ভূমিকা
হরিশচন্দ্র মুখােপাধ্যায় সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’ পত্রিকাটিতে নিয়মিতভাবে নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশিত হত। ঈশ্বরগুপ্তের সংবাদ প্রভাকর’, অক্ষয় কুমার দত্তের তত্ত্ববােধিনী পত্রিকা সমাচার দর্পণ’, ‘সােমপ্রকাশ, ‘সংবাদ ভাস্কর’ প্রভৃতি পত্রিকাতে দিনের পর দিন নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে অসংখ্য রচনা প্রকাশিত হয়। অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদক শিশিরকুমার ঘােষ নীল বিদ্রোহের কাহিনী তুলে ধরেন। সমাচার দর্পণে লেখা হয়— “যে চাষি নীলের দাদন নেয় তার মরণ পর্যন্ত খালাস নেই।”
লেখকদের ভূমিকা
নীল বিদ্রোহের ওপর বিভিন্ন সাহিত্যিক, লেখক ও কবি গল্প, নাটক ও কবিতা লিখে নীলচাষীদের বিদ্রোহে উৎসাহ জোগান। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র নীলচাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের কাহিনী নিয়ে রচনা করেন নীলদর্পণ নাটক (১৮৬০ খ্রিঃ)। এই নাটকের মাধ্যমে তিনি বিদেশী শাসক জাতির প্রজাপীড়নের সুস্পষ্ট অভিযােগ আনেন। নীলদর্পণ নাটকটি ইংরেজী অনুবাদ করে রেভারেণ্ডল-এর নামে প্রকাশিত হলে লঙকে ১মাস কারাদণ্ড ও ১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। লঙ সাহেবের কারাবাসের ফলে তিনি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন এবং তার পুস্তিকাটি পড়ে শিক্ষিত লােকেরা নীলকরদের অত্যাচার সম্বন্ধে অবহিত হয়ে নীলচাষীদের পাশে দাঁড়ান। এককথায় নীলদর্পণ নাটক নীলকরদের অত্যাচারের যথার্থ দর্পণ হয়ে উঠেছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নীলদর্পণ নাটকটিকে ‘Uncle Tom’s Cabin’ গ্রন্থটির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
আইনজীবিদের ভূমিকা
প্রখ্যাত আইনজীবি শম্ভুনাথ পণ্ডিত ও প্রসন্ন কুমার ঠাকুর অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার আহ্বান জানান। নীলকর সাহেবরা হাজার হাজার নীলচাষীর নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করত। শহুরে মধ্যবিত্ত আইনজীবিদের একাংশ এই অসহায় দরিদ্র চাষীদের পাশে দাঁড়ান এবং তাঁদের বিনা পারিশ্রমিকে আইনি সাহায্য করেন। আবার অনেকের ইচ্ছা থাকলেও নীলকরদের ভয়ে নীলচাষীদের পাশে এসে দাঁড়াতে পারেননি।
সীমাবদ্ধতা
তৎকালীন বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি। তাঁর চাননি যে নীল বিদ্রোহ সরকার বিরােধী আন্দোলন রূপে গড়ে উঠুক। রাজা রামমােহন রায় ও দ্বারকানাথ ঠাকুর ইউরােপীয়দের নীল চাষে উৎসাহী ছিলেন। তারা মনে করতেন এতে গ্রামীণ ভারতের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। চাষীদের ঘরে হা-অন্নরব উঠেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .