কুনফুসীয় অর্থনৈতিক নীতি অনুযায়ী কৃষির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাই চিনের সমাজে কৃষকেরা একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী হিসাবে চিহ্নিত হতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও উনবিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে চিনের কৃষকদের অবস্থা মােটেই ভালাে ছিল না। কুয়াং টং অণ্ডলে এবং নিম্ন ইয়াং চিন উপত্যকায় প্রচুর ভাড়াটে চাষি দেখা যেত। তারা অন্যের জমি চাষ করতেন এবং বিনিময়ে তাদের অধিক পরিমাণে কর দিতে হত। অর্থ এবং উৎপন্ন ফসল— এই দুই এর মাধ্যমেই জমিদারের পাওনা মেটাতে হত। জমিদারের প্রতি তারা নানা ধরনের প্রথাভিত্তিক কর্তব্য করতে বাধ্য থাকতেন। তাছাড়া, মাঝেমধ্যেই তাদের বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হত। অর্থাৎ বেগার প্রথার প্রচলন ছিল। যে সমস্ত কৃষকেরা নিজের জমিতে চাষ করতেন, তাদের অবস্থাও আদৌ ভালাে ছিল না। কারণ, তাদেরও বড়াে জমিদারদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হত। এক্ষেত্রে জমিদারেরা মহাজনের ভূমিকা পালন করতেন। চাষের সরঞ্জাম কেনার জন্য তাদের প্রায়ই জমিদারের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হত। জমিদারেরা সাধারণত জেন্ট্রির সদস্য হতেন এবং তারা সর্বদাই স্থানীয় ম্যান্ডারিনদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন। কর আদায়ের সময় ম্যান্ডারিন, পুলিশ এবং আদালতের সাহায্যে ভূস্বামীরা কৃষকদের ওপর যৎপরােনাস্তি অত্যাচার চালাতেন।
চিনের গ্রামীণ সমাজে আরও নানা ধরনের দরিদ্র লােক দেখা যেত। এদের মধ্যে দিন মজুর, মাঝি, ফেরিওয়ালা, কুলি প্রভৃতি ছিল উল্লেখযােগ্য। এরা সকলেই চিনের গােপন সমিতিগুলির (Secret Society) সংগঠিত করার বিষয়ে এবং গণবিদ্রোহগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
সামন্ত চিনের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য সম্ভবতঃ নিরবচ্ছিন্ন ঘটে যাওয়া একটির পর একটি কৃষক বিদ্রোহ। বস্তুত শুধু চীনদেশে নয়, বিশ্বের বহুদেশে কৃষকেরা বিভিন্ন সময়ে সামন্ততান্ত্রিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, প্রতিরােধের ধ্বজা উড়িয়েছেন। সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকশ্রেণীর এই লড়াই কখনও ছােটো আকার, আর কখনও বা বড়াে আকার নিয়েছে, কিন্তু তা কখনও থেমে যায় নি। সংগ্রাম অনেক সময়েই ধাক্কা খেয়েছে, কিন্তু তাতে কখনও দীর্ঘ ছেদ পড়েনি। বাস্তবিকপক্ষে, বিশ্বের প্রায় সমস্ত সামন্ত সমাজই কৃষক বিদ্রোহের তীব্রতা প্রত্যক্ষ করেছে। ইংল্যন্ডের জন বল, জার্মানীর টমাস মুনজার, রাশিয়ার পুগাশেভ কিংবা অধুনা বিলুপ্ত চেকোশ্লোভাকিয়ার ইয়ান হাস কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। একথা অনস্বীকার্য যে চীনদেশে কৃষক বিদ্রোহের যে নিরবচ্ছিন্ন প্ৰহমান সংগ্রামী ধারা আমরা দেখতে পাই, তা পৃথিবীর অন্য কোন দেশের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চীনের সুদীর্ঘ ইতিহাস একটার পর একটা কৃষক অভূত্থানের সাক্ষী হয়ে আছে। আধুনিক যুগের বিদ্রোহী কৃষকেরা বর্তমান সংগ্রামের প্রয়ােজনে বারবার অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন, রসদ সংগ্রহ করেছেন, প্রেরণা আহরণ করেছেন, যাতে তারা সামন্ত নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার শক্তি সঞয় করতে পারেন। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের এই মেলবন্ধন চিনের ইতিহাসে এত বার ঘটেছে যার নজীর অন্য কোন দেশের ইতিহাসে মেলা ভার।
Read More
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .