ভারতে নারী নির্যাতন
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পার করে ভারতীয় নারীর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব-নিকেশ করলে যে নির্মম বাস্তবটি আমাদের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে সেটি হল—ভারতবর্ষে শিক্ষিতা নারীর সংখ্যা এখনও যথেষ্ট কম, আর্থিকভাবে স্বনির্ভর নারীর সংখ্যাও কম, নারীত্বের ভারে জর্জরিত না হওয়া সচেতন নারীর সংখ্যা মুষ্টিমেয় বললেই চলে, কিন্তু নির্যাতিতা, লাঞ্ছিতা, অত্যাচারিতা, ধর্ষিতা, মার খাওয়া নারীর সংখ্যা অগুন্তি। সরকারি, আধা-সরকারি, বেসরকারি যে কোন পরিসংখ্যানেই নারীর বিরুদ্ধে সবরকম নির্যাতনই ক্রমবর্ধমান।
স্বাধীন ভারতে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নানানরকম আইন প্রণীত হয়েছে, নারী শিক্ষার প্রসার ঘটেছে, নারীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও বেড়েছে—এতদ্সত্ত্বেও নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের সংখ্যা কোন অংশ কমেনি। মনে রাখতে হবে নারী নির্যাতনের সংখ্যাটা আমরা পাই সরকারি তথ্য হিসাবে। সরকারি তথ্য একমাত্র পুলিশের রিপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতপক্ষে নারীর বিরুদ্ধে সংগঠিত অপরাধের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ পুলিশে রিপোর্ট করা হয়। এর কারণ দুটি—
- লোকে পুলিশকে ভয় পায় এবং এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে।
- নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন এখনও নারীরই অপরাধ বলে গণ্য হয়।
অধ্যাপক রাম আহুজা তাঁর Social Problems in India গ্রন্থে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন গুলি তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—
(১) দৈহিক নির্যাতন
ধর্ষণ, অপহরণ, খুন ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
(২) পারিবারিক নির্যাতন
পণসংক্রান্ত মৃত্যু স্ত্রীকে প্রহার, যৌন অত্যাচার, বিধবা বা বয়স্কা মহিলার প্রতি অমানবিক ব্যবহার ইত্যাদি এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
(৩) সামাজিক নির্যাতন
ইভটিচিং, স্ত্রীলোককে সম্পত্তির অংশ থেকে বঞ্চিত করা, যুবতি বিধবাকে স্বামীর সঙ্গে সহমরণে যেতে বাধ্য করা প্রভৃতি এই শ্রেণীর নির্যাতন। আগেই বলা হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে যে পরিমাণ নির্যাতন সংগঠিত হয় তার খুব সামান্য পরিমাণই জানতে পারা যায়। সরকারি তথ্য থেকে পাওয়া নির্যাতনগুলির মধ্যে নিম্নলিখিত কয়েকটি নির্যাতনকে আলাদা আলাদাভাবে আলোচনা করা হল :
(1) ধর্ষণ
নারীধর্ষণ সমস্ত দেশেই একটি সামাজিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পাশ্চাত্য দেশগুলিতে বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ও ব্রিটেনে নারীধর্ষণের হার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশী। ধর্ষিতাদের মধ্যে দরিদ্র মহিলা ছাড়াও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কর্মরতা মহিলারও কর্মস্থলে তাদের কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্যাতিত হয়। সন্দেহ জনক মহিলা অপরাধিরা পুলিশ অফিসারের দ্বারা, মহিলা রোগারী হাসপাতালের কর্মচারী দ্বারা, পরিচারিকার বাড়ির মালিক দ্বারা, দিনমজুর খাটা মহিলারা ঠিকাদার দ্বারা ধর্ষিত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে এমনকি বোবা-কালা, মানসিক ভারসাম্যহীন, অন্ধ ভিখারীর শ্রেণীর মহিলাদেরও নিষ্কৃতি নেই।
(২) অপহরণ ও হরণ
অপহরণ বলতে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা কিংবা মহিলাকে অভিভাবকের বিনা অনুমতিতে জোর করে কোথাও নিয়ে যাওয়া বোঝায়। কিন্তু হরণ বলতে বলপূর্বক প্রলোভন দেখিয়ে অথবা প্রতারণা করে কোন মহিলার সঙ্গে অবৈধ দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন অথবা তাকে বিবাহ করতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়াকে বোঝায়। যা ভারতবর্ষে আকছার ঘটছে। সারা ভারতে একদিনে অন্তত 42টি মহিলা এই উদ্দেশ্যে অপহৃতহয়।
(৩) পণ্য-সংক্রান্ত মৃত্যু
1961 সালে প্রণীত পণপ্রথা উচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে পণ দেওয়া ও নেওয়া নিষিদ্ধ করা হলেও বাস্তবিক পক্ষে পণপ্রথা আজও চলছে। উপযুক্ত বা দাবি অনুযায়ী পণ না দেওয়ার জন্য ভারতীয় নারীকে নানা প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়, এমনকি খুন পর্যন্ত হতে হয়। প্রতি বছর গড়ে 4000-এর মতো মহিলা খুন হয় পণ সংক্রান্ত কারণে।
(8) সংক্রন্ত প্রহার
স্ত্রীকে প্রহারের ঘটনাও ভারতবর্ষে কম হয় না। স্ত্রীকে প্রহার করতে করতে অজ্ঞান করে দেওয়া, হাড় ভেঙে দেওয়া, এমনকি খুন পর্যন্ত করা হয়। মজার ব্যাপার হল ভারতে বিবাহিত নারীরা স্বামীরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনই আইনের আশ্রয় নেই না, তারা এগুলিকে তাদের বিধিলিপি বলেই ধরে নেয়। ইচ্ছা থাকলেও প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না দু-কূল হারাবার ভয়ে। শ্বশুরকুল তো যাবেই, আবার বাপের বাড়িতে ও ঠাঁই না পাওয়ার ভয় থাকে।
(৫) বিধবাদের বিরুদ্ধে নির্যাতন
অধ্যাপক আহুজা বিধবাদের তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন— (ক) বিয়ের ১-২ বছরের মধ্যে বিধবা যাদের কোনো সন্তান নেই। (খ) বিয়ের ৫-১০ বছরের মধ্যে বিধবা যাদের এক বা দুইটি সন্তান আছে এবং (গ) পঞ্চাশোর্ধ্ব বিধবা। এই তিন শ্রেণী বিধবাদেরই কম বেশী সামাজিক, আর্থিক ও মানসিক নির্যাতন ভোগ করতে হয়। এই তিন শ্রেণীর মধ্যে তৃতীয় শ্রেণী বিধবাদের কম নির্যাতন ভোগ করতে হয়। স্বামীর গৃহে এদের গ্রহণযোগ্যতাও বেশী। সবচেয়ে বড় কথা এই. শ্রেণী বিধবাদের অপর দুই শ্রেণীর ন্যায় জৈবিক কোনো সমস্যা থাকে না। বিধবাদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের ক্ষেত্রে মূলত তিনটি উপাদান কাজ করে—ক্ষমতা, সম্পত্তি এবং যৌন আবেদন।
সবশেষে ইভটিজিং-এর বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়। ইভটিজিং নারী নির্যাতনের একটি রূপ। রাস্তাঘাটে, স্কুল-কলেজে অফিস-আদালতে মেয়েদের প্রায়শই এর শিকার হতে হয়। এর শিকার হয়ে অনেক মেয়েকে ‘স্কুল বা কলেজ ছাড়তে হয়, বাড়িতে বন্দী থাকতে হয়, কাউকে কাউকে কলেজা ছাড়তে হয়, বাড়িতে বন্দী থাকতে হয়, কাউকে কাউকে চাকরী ছাড়তে হয়, এমনকি আত্মহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যায়।
বিংশ শতাব্দীর ৮০-এর দশকে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেবেশ কিছু সংস্কারমূলক আইন প্রবর্তিত হয়। আশা করা হয়েছিল যে এই সব আইন নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের সংখ্যা কমিয়ে দেবে বাস্তবে কিন্তু উল্টোটাই ঘটেছে। এর জন্য ভারতীয় নারীর মানসিকতা, সামাজিক প্রতিকূলতা পুলিশী ব্যর্থতা এসব তো আছেই, এদেশের বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা ও এর জন্য কম দায়ি নয়। আইনের ফাঁক দিয়ে এক বিচারের নামে অবিচারের সুযোগ নিয়ে বহু অপরাধই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .