বিজয়নগরের সামাজিক জীবন
বিজয়নগরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশি পর্যটক আসেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন পায়েজ, নুনিজ, বারবােসা, নিকোলাে কন্টি, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ। তারা বিজয়নগরের তৎকালীন সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তাদের বিবরণে আলােচনা করেছেন।
সমকালীন বিদেশি পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সামাজিক জীবনের যে পরিচয় পাওয়া যায় তা হল-
ব্রাত্মণ্য শ্রেণির প্রাধান্য
বিজয়নগরের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে ব্রাত্মণদের যথেষ্ট আধিপত্য ছিল। বেদের ভাষ্যকার সায়নাচার্য ছিলেন দ্বিতীয় হরিহরের মন্ত্রী। ব্রাক্ষ্মণরা ছিলেন উদার ও ধর্মসহিষ্ণু। তাঁরা ছিলেন নিরামিষাশী। ইতিহাসবিদ ড, রােমিলা থাপার বলেছেন যে, ব্রাক্ষ্মণরাই রাজার প্রধানমন্ত্রী হতেন। পাের্তুগিজ পর্যটক নিজ বিজয়নগরের ব্রাত্মণদের মেধার তীক্ষ্ণতা, হিসাবপত্র রাখার ক্ষমতা, দৈহিক কৃশতা ও কঠিন কায়িম পরিশ্রমে দক্ষতার উল্লেখ করেছেন।
বর্ণপ্রথার প্রচলন
বিজয়নগরের সমাজব্যবস্থার বর্ণপ্রথা যথেষ্ট তীব্র ছিল। সমাজে ব্রাম্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চার বর্ণের মানুষ ছিলেন। ব্রাত্মণরা ছিলেন সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। পাের্তুগিজ পর্যটক বলেছেন যে, গ্রামগুলিতে হিন্দুদের সংখ্যা বেশি ছিল এবং মুসলমান ছিল খুব কম। তবে জাতিভেদ বা বর্ণভেদ থাকলেও বিভিন্ন বর্ণের মানুষের মধ্যে যথেষ্ট মেলামেশা ও যােগাযােগ ছিল। চণ্ডালরা সমাজের মূল অংশে বাস করতে পারতেন না। তারা নগরের বাইরে বসবাস করতেন।
ধর্মনিরপেক্ষতা
বিজয়নগরের রাজারা ছিলেন বিয়ুর উপাসক। তবে তাঁরা ধর্মীয় ক্ষেত্রে উদার ছিলেন এবং অন্য ধর্মের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শাসনব্যবস্থাতেও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্রাক্ষ্মণদের আধিপত্য থাকলেও বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, ইহুদি, ইসলাম প্রভৃতি সকল ধর্মের মানুষই সেখানে নিরাপদে বসবাস করতেন। সমাজে আলবার নামে বৈষব সম্প্রদায় এবং নায়নার নামে শৈবধর্মের অনুরাগীদের প্রাধান্য ছিল। পর্যটক বারবােসা রাজা কৃয়দেব রায়ের আমলের ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে লিখেছেন যে, তার সাম্রাজ্যে যে কেউ আসতে পারত, এখানে থাকতে পারত এবং নিজধর্ম পালন করে শান্তিতে বসবাস করতে পারত। সে খ্রিস্টান, ইহুদি, নিগ্রো বা ধর্মহীন কি না—এ বিষয়ে কেউ তাকে প্রশ্ন করত না।
নারীর মর্যাদা
বিজয়নগরের ব্রাম্মণ্য সমাজব্যবস্থায় নারীজাতির বিশেষ মর্যাদার আসন ছিল। নারীরা অবাধ স্বাধীনতা ভােগ করতেন। সমাজ, রাজনীতি, সামরিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তাঁরা নৃত্য, সংগীত, সাহিত্য, শাস্ত্রচর্চা, কারুশিল্প, চারুশিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রের যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। মল্লক্রীড়া, অসিচালনা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও নারীদের দক্ষতা ছিল। এই সময়কার বিজয়নগরের বিদুষী নারীদের মধ্যে তিরুমালাম্মা, হােনাম্মা, গঙ্গাদেবী প্রমুখ বিশেষভাবে স্মরণীয়। নুনিজ বলেছেন যে, রাজার অধীনে অসংখ্য নারী কুস্তিগির, জ্যোতিষী, হিসাবরক্ষক, প্রহরী থাকতেন।
সামাজিক কুপ্রথা
বিজয়নগরের সমাজ ব্যবস্থায় বহু কুসংস্কারের প্রভাব ছিল। নারীদের বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা, পুরুষদের বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথা সমাজে প্রচলিত ছিল। বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে নুনিজ অচ্যুত রায়ের পাঁচশাে পত্নীর এবং পায়েজ কৃয়দেব রায়ের বারােজন পত্নীর উপস্থিতির উল্লেখ করেছেন। অভিজাত পরিবারের নৃত্যগীতে পারদর্শী মেয়েদের হিসেবে মন্দিরে উৎসর্গ করা হত। কোনাে কোনাে মন্দিরে আনুমানিক ১৭০০ থেকে ২৫০০ দেবদাসী ছিল বলে জানা যায়।
খাদ্যাভ্যাস
বিজয়নগরের মানুষ চাল, গমের তৈরি খাদ্য, বিভিন্ন ফলমূল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য প্রভৃতি খেত। ব্রাত্মণ সম্প্রদায় ছিল নিরামিষাশী। তবে সাধারণ মানুষ মাছ, মাংস ইত্যাদি খেত। গােমাংস ভক্ষণ ধর্মীয় কারণে নিষিদ্ধ ছিল। অবশ্য বিজয়নগরের রাজা কৃয়দেব রায় এবং অচ্যুত রায় বিয়ুর উপাসক হলেও পশুপাখির মাংস খেতেন বলে জানা যায়।
পােশাকপরিচ্ছদ ও বিনােদন
বিজয়নগরের সাধারণ মানুষ সহজসরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল। তবে ধনী ও অভিজাতদের জীবনযাত্রার বিলাসিতার ছাপ ছিল। অভিজাত পুরুষরা দামি জুতাে ও সিল্কের পাগড়ি পরতেন এবং উত্তরীয় ব্যবহার করতেন। নারীরা মেঘলা বা ঘাঘরা ও ওড়না-জাতীয় দুই খণ্ড বস্ত্র পরিধান করতেন। নারী-পুরুষ উভয়েই সােনা, রুপাে ও মূল্যবান রত্নের অলংকার ব্যবহার করতেন। বিজয়নগরের মানুষের অবসর বিনােদনের প্রধান মাধ্যম ছিল নাচ, গান, কুস্তি, নৌকাদৌড় ইত্যাদি।
বিজয়নগরের অর্থনৈতিক জীবন
সমকালীন বিদেশি পর্যটক পায়েজ, নুনিজ, আবদুর রজ্জাক, এডােয়ার্ড বারবােসা, নিকোলাে কন্টি প্রমুখ বিজয়নগরের বিপুল ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এখানে কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসাবাণিজ্যের উন্নতির ফলে অর্থনীতিতে সমৃদ্ধি এসেছিল। দেশে সামন্ততান্ত্রিক মন্দির-অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল।
কৃষিকার্য
বিজয়নগরের কৃষিকার্য যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। কৃষি ছিল প্রজাদের প্রধান জীবিকা। এই সময় কৃষিজমির মালিকানা জমিদার, মঠ ও মন্দিরগুলির হাতে চলে গিয়েছিল। তাই কৃষকরা দিনমজুরে পরিণত হয়েছিল। যদিও নুনিজ বলেছেন, রাজার অধীনেই দেশের সমস্ত জমি থাকত। তবে সাধারণ কৃষকরা মােহান্ত বা অমরনায়কদের ফসলের ৯/১০ অংশ কর দিতে বাধ্য হত। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরবর্তী রায়চুরের উর্বর মাটিতে ভালাে ফসল ফলত। এখানে ধান, গম, যব, কলাই, মশলা, তুলাে প্রভৃতি উৎপাদিত হত।
শিল্প
বিজয়নগরে বিভিন্ন শিল্পের কাজেও উৎকর্য এসেছিল। সেখানকার বিভিন্ন শিল্পের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল বস্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প, যন্ত্রশিল্প, খনিজ উৎপাদন। শিল্প, গন্ধদ্রব্যের শিল্প ইত্যাদি। বিজয়নগরে বড়াে জাহাজ তৈরির কারখানাও ছিল বলে। বারবােসা উল্লেখ করেছেন। সাম্রাজ্যে যথেষ্ট কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছিল। আবদুর রজ্জাক ও পায়েজ বলেছেন যে, শিল্পের কাজে তদারকির জন্য কারিগর ও বণিকদের পৃথক পৃথক সংঘ’ বা ‘গিল্ড’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
ব্যাবসাবাণিজ্য
স্থলপথে গােরুর গাড়ি, ঘােড়ার গাড়ি ও জলপথে নৌকার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য সচল ছিল। বিজয়নগরের বৈদেশিক বাণিজ্যও উন্নত
ছিল। আবদুর রজ্জাক লিখেছেন যে, বিজয়নগরে ৩০০টি বন্দর ছিল এবং এই বন্দরগুলি থেকে আফ্রিকা, চিন, পারস্য, আরব, আবিসিনিয়া, পাের্তুগাল, ব্ৰহ্লাদেশ, মালয়, আলেকজান্দ্রিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চলত। বারবােসা লিখেছেন যে, বিজয়নগর শহরটি ছিল গােলকুন্ডার হিরে, পেগুর চুনি, চিন ও আলেকজান্দ্রিয়ার রেশম, মালবার উপকূলের সিদুর, কপূর, গােলমরিচ,চন্দন কাঠ ও কস্তুরী বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। তিনি আরও লিখেছেন যে, বিজয়নগরের বণিকরা চাল, চিনি, কাপড়, লােহা, গন্ধক, ভেষজদ্রব্য, মশলা ইত্যাদি রপ্তানি করত এবং আরবি ঘােড়া, হাতি, রেশম বস্ত্র, ভেলভেট, মণিমুক্তা, প্রবাল, তামা, পারদ ইত্যাদি আমদানি করত। বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে বিজয়নগরের প্রচুর আয় হত। গিল্ডগুলি দেশের ব্যাবসাবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা নিত।
মুদ্রাব্যবস্থা ও রাজস্ব
বিজয়নগরের মুদ্রাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত ছিল। সােনা, রূপাে ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল। মুদ্রায় বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি ও পশুপাখির ছবি খােদাই করা থাকত। সরকারের আয়ের মূল উৎস ছিল ভূমিরাজস্ব। উর্বরতা অনুসারে কৃষিজমিকে তিনভাগে ভাগ করা হত। যথা—(১) আর্দ্র জমি, (২) নীরস জমি এবং (৩) ফলের বাগান বা বনভূমি। রাজা উৎপন্ন ফসলের ১/৬ অংশ ভূমিরাজস্ব হিসেবে কৃষকের কাছ থেকে আদায় করতেন। এ ছাড়া, সম্পদ কর, যুদ্ধ কর, চারণ কর, বিবাহ কর, বিক্রয় কর, মন্দিরকে প্রদেয় কর, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক প্রভৃতি আদায় করা হত। দেশে উচ্চশ্রেণির মানুষজন অর্থসম্পদে সচ্ছল ছিলেন।
মন্দির-অর্থনীতি
বিজয়নগরে আগে যে গ্রাম-পরিষদগুলি ছিল তা ক্রমে ভেঙে পড়তে থাকে। রাষ্ট্রীয় পরিষদ নিগমগুলি (State Council guild) সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এভাবে ক্রমে মন্দির-অর্থনীতির বিকাশ ঘটতে থাকে। মন্দিরগুলি আধুনিক ব্যাংকের মতাে সুদে টাকা ধার দিত। মন্দিরের মহান্ত বা অমরনায়করা দরিদ্র কৃষক, কারিগর এমনকি ধনী ব্যবসায়ী বা রাষ্ট্রকেও সুদে টাকা ধার দিতেন। কৃষকরা যথাসময়ে ঋণ শােধ করতে না পারলে তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করা হত।
উপসংহার
বিজয়নগরের সমাজ ও অর্থনীতিতে যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছিল। কিন্তু প্রদীপের নীচেই যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি বিজয়নগরের এই আর্থিক সমৃদ্ধিও একটি বিশেষ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অপর শ্রেণি দারিদ্যের অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল। সাম্রাজ্যের ধনী-দরিদ্রের এই ব্যবধান ছিল যথেষ্ট তীব্র। পায়েজ, নুনিজ প্রমুখ বলেছেন যে, অভাবের তাড়নায় মানুষ ইঁদুর, বিড়াল, টিকটিকি ইত্যাদিও খেত। দারিদ্যে জর্জরিত সাধারণ মানুষের সমাজে তাই দুঃখকষ্টের সীমা ছিল না। অন্যদিকে অর্থসম্পদে সমৃদ্ধ ধনী ও অভিজাতরা বিলাসব্যসনে পা ভাসিয়ে দিত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .