ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে ভারতের ব্রিটিশ বিরােধী মনােভাব ও জাতীয়তাবাদী চেতনা ক্রমশ সংগঠিত রূপ নেয়। সংগঠিত ভাবে সরকারের অন্যায়ের প্রতিবাদ ও স্বাধিকার অর্জনের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক সংগঠনের উদ্ভব ঘটে। ভারতে রাজনৈতিক চেতনার প্রথম শিক্ষক ছিলেন রাজা রামমােহন রায়। পরবর্তীতে নব্যবঙ্গ দলের সদস্যরা ভারতে রাজনৈতিক সংগঠনের কাজে লিপ্ত হন। ১৮৫৮-১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বাংলা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে একাধিক রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে। এই কারণে ড, অনিল শীল উনিশ শতককে ‘সভাসমিতির যুগ’ বলেছেন।
বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা
১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে টাকির জমিদার কালীনাথ রায়চৌধুরী দ্বারকানাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য রামমােহন- শিষ্যদের উদ্যোগে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ ‘সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখেছিলেন, “রাজকীয় বিষয়ের বিবেচনার জন্য অপর যে সভা হইয়াছিল, তন্মধ্যে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা’কে প্রথমা বলিতে হইবেক।” যােগেশচন্দ্র বাগলও এই মত সমর্থন করে বলেছেন, “এটা (বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা) বাঙালী তথা ভারতবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান।”
জমিদার সমিতি
তবে বঙ্গভাষা প্রকাশিকা সভা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই লুপ্ত হয়। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় জমিদার সমিতি। রাজনৈতিক সমিতিরূপে এটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
রাজা রাধাকান্ত দেব ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উদ্যোগে এই সমিতির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজে। এর সভাপতি ছিলেন রাধাকান্ত দেব এবং সম্পাদক ছিলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। এই সমিতির সদস্য হওয়ার একমাত্র যােগ্যতা ছিল জমিদার হওয়া। ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে এই সমিতির নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ল্যান্ড হােল্ডার্স সােসাইটি। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মতে, এই সমিতি ছিল স্বাধীনতার পুরােধা।
ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সােসাইটি
ভারতবাসীর কল্যাণার্থে ইংরেজ সমাজকে ভারতের প্রকৃত অবস্থা জানানাের জন্য রামমােহন সুহৃদ উইলিয়াম অ্যাডাম ইংল্যান্ডে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সােসাইটি, (জুলাই, ১৮৩৯) প্রতিষ্ঠা করেন। বিখ্যাত বাগ্মী জর্জ টমসন এই সমিতির সদস্য ছিলেন। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে অ্যাডাম এই সমিতির একটি সাপ্তাহিক মুখপত্র ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাডভােকেট প্রকাশ করেন।
বেঙ্গল ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া সােসাইটি
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে ‘দি সােসাইটি’ নামে আর একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। উদারপন্থী ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ জর্জ টমসন এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন। প্রধানত ইংরেজি শিক্ষাপ্রাপ্ত তরুণেরা এই সমিতির সদস্য হতে পারত। এদের দাবিগুলি ছিল অনেক স্পষ্ট ও বাস্তব। এই সমিতির দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে অধিক সংখ্যক ভারতীয়কে নিযুক্ত করা, বিচারকদের আদালতে ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতা প্রভৃতি।
ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসােসিয়েশন’ নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। প্রথম থেকেই এটি ছিল একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান। শুধুমাত্র ভারতীয়রাই এর সদস্য হতে পারত। এই প্রতিষ্ঠান বহু বছর ধরে শিক্ষা, শাসনসংস্কার, বিচারব্যবস্থা, নীলচাষ প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে দেশে আন্দোলন গড়ে তােলে। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে সমিতির পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বিষয়ে এক দাবিপত্র পাঠানাে হয়। মাদ্রাজ ও অযােধ্যায় এই সমিতির শাখা স্থাপিত হয়।
ইন্ডিয়ান লিগ
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার ঘােষ ও হেমন্তকুমার ঘােষের উদ্যোগে ভারতীয় জনসাধারণের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়ান লিগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। চাষি, মজুর, বুদ্ধিজীবী সহ সমস্ত স্তরের ভারতবাসী ইন্ডিয়া লিগের সদস্য পদ লাভ করে। ইংলিশম্যান’ পত্রিকা ইন্ডিয়ান লিগের প্রতিষ্ঠাকে ভারতীয় গণজাগরণের প্রথম অস্পষ্ট সূচনা’ বলে অভিহিত করেছেন।
ভারতসভা
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৬ জুলাই সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমােহন বসু, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে এক বিশাল জনসমাবেশ কলকাতার অ্যালবার্ট হলে ‘ভারতসভা’র প্রতিষ্ঠা হয়। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন এই সভার প্রাণপুরুষ। এই সভার লক্ষ্য ছিল যুবশক্তিকে সংগঠিত করা এবং দেশে শক্তিশালী জনমত গঠন করা। প্রায় সমস্ত শ্রেণির মানুষ এই সভার সভ্য ছিলেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস সংক্রান্ত আইনকানুনের বিরুদ্ধে ভারতসভার প্রথম আন্দোলন। ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে ইউরােপীয়গণ আন্দোলন করলে ভারতসভা প্রতিআন্দোলন করে। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটে। ধীরে ধীরে ভারতসভা সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সমিতিতে পরিণত হয়। বস্তুত এই সমিতিই জাতীয় সংগ্রামের পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল।
বাংলার বাইরে
রাজনৈতিক সভাসমিতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভারতের অন্য দুই প্রেসিডেন্সিও পিছিয়ে ছিল না। বােম্বাই ও মাদ্রাজেও এই সময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক সমিতি গড়ে ওঠে। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বােম্বাই নেটিভ অ্যাসােসিয়েশন’ (১৮৫২), ‘পূর্ণ সার্বজনিক সভা (১৮৭০), ‘বােম্বাই প্রেসিডেন্সি অ্যাসােসিয়েশন’ (১৮৮৫) এবং মাদ্রাজ নেটিভ অ্যাসােসিয়েশন’ (১৮৫২), মাদ্রাজ মহাজন সভা’ (১৮৮৪)। এই সমস্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক সমিতির মাধ্যমে ভারতীয়দের রাজনৈতিক চেতনা পরিণত হয়ে ওঠে। এর অবশ্যম্ভাবী ফল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা।
নানা ত্রুটি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও জাতীয় জীবনে এই রাজনৈতিক সভাগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-আঞ্চলিকতা-ভাষা প্রভৃতি ব্যবধান অতিক্রম করে এই সর্বপ্রথম একটি সর্বভারতীয় ঐক্য স্থাপনে উদ্যোগ দেখা যায়। এছাড়া এই সমিতিগুলি সর্বভারতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত করে আগামী দিনে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করে দেয়। ড. অনিল শীল বলেন, “রাজনৈতিক সমিতি গঠনের মাধ্যমে উনিশ শতকে ভারতবর্ষ আধুনিক রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করে।”
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .