মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার কারণ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ যে দ্রুতগতিতে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যে তৎপরতার সঙ্গে তারা দিল্লী দখল করে নিয়ে ছিল তা ইংরেজদের উদ্বেগ ও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সমস্ত অনুকূল পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়েছিল। এই বিদ্রোহের ব্যর্থতা অবশ্য অস্বাভাবিক ছিল না। এর কতকগুলি কারণ ছিল।
১) নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাব
যে কোন বৃহত্তর গণ আন্দোলন সফল করার প্রাথমিক শর্তই হল সুদৃঢ় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। মহাবিদ্রোহের ক্ষেত্রে এই প্রাথমিক শর্তের অভাব ছিল প্রকট। বিদ্রোহীদের কোন কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না, ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচী ছিল না। ভারতবাসীর কাছে বাহাদুর শাহের ভাবমূর্তি ছিল খুবইম্লান। নানাসাহেব,লক্ষীবাঈ ব্যক্তিগতভাবে দক্ষ হলেও, তাঁদের কোনরূপ জাতীয় ভাবমূর্তি ছিল না। ফলে আন্দোলন ছিল বিচ্ছিন্ন, তাই দুর্বল। পাঞ্জাবের শাসক ও ইংরেজ সেনাপতি হেনরী লরেন্স স্বীকার করেছেন যে, সিপাহীদের মধ্যে যদি একজনও প্রতিভাবান নেতা থাকত, তাহলে আমাদের। সর্বনাশ হত।
২) লক্ষ্যের বিভিন্নতা
বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দের লক্ষ্যের ভিন্নতা আন্দোলনের প্রাণশক্তি শিথিল করে। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের লক্ষ্য ছিল দিল্লীর সিংহাসন এবং ভারত সম্রাট পদ লাভ। নানা সাহেবের লক্ষ্য ছিল পেশােয়ার স্বাধীন কর্তৃত্ব ও মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা। অন্যান্য নেতৃবৃন্দের লক্ষ্য ছিল পরস্পর বিরােধী। যার ফলে বিদ্রোহ প্রথম থেকেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩) আধুনিক অস্ত্র ও রণকৌশলের অভাব
বিদ্রোহীদের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ ছিল। অর্থ, রসদ, সমর উপকরণ ও রণকৌশলের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের মধ্যেকার বিশাল পার্থক্য। ব্রিটিশ পক্ষ যেখানে প্রচুর অর্থ এবং আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ও উন্নত রণকৌশলের অধিকারী ছিল, সিপাহীরা সেখানে ছিল সীমিত অর্থ, নিকৃষ্টমানের অস্ত্রশস্ত্র ও পুরাতন যুদ্ধপদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
৪) রাজনৈতিক চেতনার অভাব
রাজনৈতিক চেতনার অভাব বিদ্রোহের ভিত্তি দুর্বল করেছিল। সুপ্রকাশ রায়ের মতে, বৈপ্লবিক সংগ্রাম পরিকল্পনার মতন আধুনিক বুজোয়াগােষ্ঠী ও শ্রমজীবি শ্রেণী তখন ভারতে ছিল না। ফলে বিদ্রোহীরা চালিত হয়েছিল তথাকথিত সামন্ততান্ত্রিক ব্যবহার দ্বারা। এই গােষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে কৃষক শ্রেণীকে সর্বদা বিদ্রোহ থেকে দূরে রাখতে প্রয়াসী ছিল। অমলেন্দু দাশগুপ্ত, ‘Out first national war’ প্রবন্ধে। এই মত সমর্থন করে লিখেছেন, “ব্রিটিশের উন্নত ও শক্তিশালী অস্ত্রের প্রতিরােধ করার জন্য প্রয়ােজন ছিল ব্যাপক গণ-চেতনা ও গণ-অভ্যুত্থানের। কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক নেতৃত্ব গ্রামীণ শ্রমজীবি শ্রেণীকে এই অভ্যুত্থানের সামিল করতে সাহসী হননি।”
৫) শৃঙ্খলার অভাব
শক্তিশালী প্রতিকারের বিরুদ্ধে সাফল্য লাভ করতে হলে যে শৃঙ্খলাবােধ, আনুগত্য ইত্যাদি গুণের একান্ত প্রয়ােজন, বিদ্রোহীদের মধ্যে তাঁর যথেষ্ট অভাব ছিল। যার ফলে তারা বহু ক্ষেত্রেই জনসমর্থন হারায়।
৬) বুদ্ধিজীবিদের বিরূপতা
দেশের বুদ্ধিজীবিদের বৃহত্তর অংশ মহাবিদ্রোহের বিরােধিতা করে আন্দোলনের প্রাণশক্তিকে দুর্বল করেছিলেন। সিন্ধিয়া, হােলকার নিজাম, বহু রাজপুত গােষ্ঠী, ভুপালের নবাব প্রমুখ বিদ্রোহ দমনের কাজে সর্বশক্তিসহ ইংরেজের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবি শ্রেণীর প্রতিবিপ্লবী মানসিকতা বিদ্রোহীদের মনােবল হ্রাস করে।
৭) উন্নত যােগাযােগের অভাব
ডাক ও তার বিভাগের সাহায্যে ইংরেজরা বিদ্রোহের দ্রুত খবর পেয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে জলপথ ও রেলপথে সেনা পাঠিয়ে ব্যবস্থা নিতে পেরেছিল। এইসব সুযােগ থেকে ভারতীয় সিপাহীরা বঞ্চিত হওয়ায় তারা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়েছিল। তাই তারাচাঁদ যথার্থই বলেছেন— “The tailure of the revolt was almost a forgone concluson”.
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .