হুসেন শাহি আমলে বাংলার অগ্রগতি
হাবশি সুলতান মুজাফরের উজির আলাউদ্দিন হুসেন শাহ অত্যাচারী হাবশি শাসক মুজাফফরকে হত্যা করে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় হুসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। হুসেন শাহি বংশ বাংলায় একাদিক্রমে ১৪৯৩ থেকে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মােট ৪৫ বছর রাজত্ব করে। এই সময় বাংলার সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরম অগ্রগতি লক্ষ করা যায়। ইতিহাসবিদ ড. হাবিবুল্লা বলেছেন যে, হুসেন শাহি বংশের রাজত্বকাল ছিল নজিরবিহীন কর্মোদ্যম, শান্তি, সমৃদ্ধি এবং বৃহৎ সামরিক বিজয়ের অধ্যায়।
হুসেন শাহি আমলে রাজনৈতিক অগ্রগতি
হুসেন শাহি বংশের সুলতানরা সিংহাসনে বসে একদিকে যেমন বাংলায় হাবশি কুশাসনের অরাজকতা ও নৈরাজ্য দূর করে শান্তি স্থাপন করেন, অন্যদিকে তেমনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা ও সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
(১) অরাজকতার অবসান
১৪৮৭ থেকে ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হাবশিদের শাসনকালকে বাংলার ইতিহাসে ‘অন্ধকার যুগ বলা হয়। এই সময় বাংলার সমাজজীবনে সমস্ত ক্ষেত্রে চূড়ান্ত নৈরাজ্য ও অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে হাবশি শাসক মুজাফফরকে তার উজির হুসেন শাহ হত্যা করে বাংলার সিংহাসনে বসলে বাংলায় নৈরাজ্য ও অরাজকতার অবসান হয়।
(২) শান্তি প্রতিষ্ঠা
হুসেন শাহি আমল ছিল বাংলার শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ। এই সময় বাংলায় নিরবচ্ছিন্ন শান্তি বজায় ছিল। রাজ্যের কোনাে স্থানে অরাজকতা, অশান্তি বা বিদ্রোহ এ সময় মাথা তােলেনি। শান্তি বজায় থাকায় দেশের অর্থনৈতিক কাজকর্ম গতিশীল ছিল। এই আর্থিক সমৃদ্ধির ফলে সংস্কৃতির বিকাশও সম্ভব হয়েছিল।
(৩) স্বাধীনতা রক্ষা
হুসেন শাহি রাজারা যখন বাংলায় শাসন পরিচালনা করেন তখন দিল্লি সুলতানির প্রবল প্রতাপ-প্রতিপত্তি ছিল। এ ছাড়া প্রতিবেশী রাজ্যের আক্রমণের ভয়ও ছিল। কিন্তু হুসেন শাহি বংশের রাজারা দিলিম লতান ও বাংলার প্রতিবেশী রাজাদের আক্রমণ প্রতিহত করে বাংলার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেন।
(৪) সামাজ্যবিস্তার
শুধু নিজের রাজ্য রক্ষা নয়, হুসেন শাহি শাসকরা অবিরাম যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার রাজ্যসীমা সম্প্রসারণের কাজ চালিয়ে গেছেন। পাশ্ববর্তী বিহার, উড়িষ্যা, কামতাপুর, আসাম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের বিভিন্ন অংশ দখল করে, এই সম্প্রসারণ সম্ভব হয়েছিল। এই সময় বাংলার রাজ্যসীমা ছিল উত্তর-পূর্বে কুচবিহার, দক্ষিণে চট্টগ্রাম, দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যার অংশবিশেষ এবং পশ্চিমে ত্রিহুত। হুসেন শাহের পুত্র সুলতান নসরৎ শাহ আফগানদের সঙ্গে জোট গঠন করে মােগল সম্রাট বাবরের আক্রমণ প্রতিহত চেষ্টা করেন।
(৫) ধর্মনিরপেক্ষতা
হুসেন শাহি সুলতানরা বাংলায় এক ধর্মনিরপেক্ষ, উদার ও মানবতাবাদী প্রশাসন গড়ে তােলেন। এই সময় যােগ্যতাসম্পন্ন হিন্দুরা প্রশাসনের বিভিন্ন পদ লাভ করেন। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের উজির ছিলেন গােপীনাথ বসু, ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন রূপ গােস্বামী, রাজস্ব মন্ত্রী ছিলেন সনাতন গােস্বামী, সেনাপতি ছিলেন গৌর মল্লিক, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন মুকুন্দ দাস, দেহরক্ষী ছিলেন কেশব ছেত্রী, মুদ্রাশালার অধিকর্তা ছিলেন অনুপ। এ ছাড়া অন্য হিন্দু রাজকর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন চিরঞ্জীব সেন, বল্লভ, শ্রীকান্ত, দামােদর প্রমুখ। উদার শাসনতান্ত্রিক পরিবেশের জন্যই শ্রীচৈতন্যদেব বাংলায় ভক্তিধর্মের প্রচার করে সাংস্কৃতিক নবজাগরণ ঘটাতে পেরেছিলেন। কোনাে কোনাে ইতিহাসবিদ হুসেন শাহকে ‘বাংলার আকবর’ বলে অভিহিত করেন।
হুসেন শাহি আমলে সাংস্কৃতিক অগ্রগতি
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হুসেন শাহি আমলে বাংলায় এক নবযুগের সূচনা হয়েছিল। বাংলা সাহিত্য, সংগীত, ধর্ম, শিল্প, হস্তলিপি প্রভৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রেএই সময় উল্কর্য লক্ষ্য করা যায়।
(১) বাংলা সাহিত্যে অবদান
অনেক ইতিহাসবিদদের ধারণা হুসেন শাহ আমলে বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণ ঘটে। আলাউদ্দিন হুসেন শাহ বিভিন্ন কবি ও সাহিত্যিকের পৃষ্ঠপােষকতা করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মালাধর বসু, কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী, যশােরাজ খাঁ, দামােদর, কবিরঞ্জন, শ্রীধর, বিজয় গুপ্ত প্রমুখ। মালাধর বসুকে অনেকে ইলিয়াস শাহি সুলতান বরবক শাহের সঙ্গে যুক্ত করলেও স্যার যদুনাথ সরকার মনে করেন যে, হুসেন শাহের আমলেই মালাধর বসু ‘গুণরাজ খা’ এবং তাঁর পুত্র ‘সত্যরাজ খাঁ’ উপাধি লাভ করেন। হুসেন শাহি যুগে বৈয়ব কবি রূপ গােস্বামী সংস্কৃত ভাষায় বিদগ্ধমাধব এবং ললিতমাধব নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেন। সেনাপতি পরাগল খাঁ-র পৃষ্ঠপােষকতায় কবীন্দ্র পরেমশ্বর বাংলা ভাষায় মহাভারতের অনুবাদ করেন। কৃয়দাস কবিরাজ চৈতন্যচরিতামৃত বিপ্রদাস পিপিলাই মনসামঙ্গল, জয়ানন্দ চৈতন্যমঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন। বৈয়ব পদাবলির কবি জ্ঞানদাস, গােবিন্দদাস প্রমুখ হুসেন শাহি আমলে তাদের পদগুলি রচনা করেন।
(২) সংগীতে অবদান
হুসেন শাহি আমলে রাজকীয় পৃষ্ঠপােষকতায় সংগীতের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে। সংগীতকে বিষয় করে এই যুগে কাব্য রচনার কথা জানা যায়। হুসেন শাহি আমলের বাংলা কাব্যে ‘কেদার’, ‘ধানশ্রী’, মল্লার’, ‘ভৈরবী প্রভৃতি রাগিণীর উল্লেখ আছে। উত্তর ভারতের উচ্চাঙ্গ সংগীতের রাগরাগিণীও বাংলা সংগীতে প্রচলিত ছিল।
(৩) হস্তলিপিবিদ্যায় অবদান
হুসেন শাহি আমলে হস্তলিপিবিদ্যায় প্রভূত উন্নতি লক্ষ করা যায়। এই যুগে আরবি ও পারসিক ভাষায় শিলালিপি খােদাই করা হয়। হুসেন শাহি যুগের মুদ্রাতেও হস্তলিপিবিদ্যার উৎকর্ষের প্রমাণ মেলে। ড. এম. আর. তরফদার হুসেন শাহি আমলের হস্তলিপিবিদ্যার প্রশংসা করেছেন।
(৪) থাপত্যশিল্পে অবদান
হুসেন শাহি আমলে পূর্বতন ইলিয়াস শাহি আমলের অগ্রগতির ধারা বজায় ছিল। বাংলার বিভিন্ন স্থানে সুলতানদের উদ্যোগে বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, খাক্কা, প্রাসাদ, দরগা, ফটক প্রভৃতি নির্মিত হয়। আলাউদ্দিন। হুসেন শাহের উদ্যোগে গৌড়ে গুণমন্ত মসজিদ, দরমাবাড়ি মসজিদ ও ছােটোসােনা মসজিদ ইত্যাদি নির্মিত হয়। নসরৎ শাহের আমলে কদম রসুল মসজিদ, বড়ােসােনা মসজিদ এবং পাণ্ডুয়ায় হুসেন শাহের সমাধির ওপর একলাখি মসজিদ নির্মিত হয়। একলাখি মসজিদ ও বড়ােসােনা মসজিদ হুসেন শাহি যুগের অনবদ্য স্থাপত্য নিদর্শন। শিল্প সমালােচক ফার্গুসন বড়ােসােনা মসজিদকে গৌড়ের শ্রেষ্ঠ সৌধ বলে অভিহিত করেছেন।
(৫) ধর্মীয় জীবনে অবদান
হুসেন শাহি যুগ ছিল ধর্মসহিষ্ণুতা ও ধর্মসমন্বয়ের যুগ। এই যুগে হিন্দুধর্মে ব্রাত্মণ্য, বৈয়ব, শাক্ত ও শৈব ধারা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ ছাড়া ধর্মঠাকুর, মনসা চণ্ডী প্রভৃতি আঞ্চলিক দেবদেবীর পূজা ও ধর্মমতের প্রচলন হয়। এইসব দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করে বিভিন্ন গ্রন্থ রচিত হয়। এই সময় হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই সত্যপিরের পূজা শুরু করে। শ্রীচৈতন্যদেব বৈবধর্মের প্রচার করে বাংলায় ভক্তিধর্মের জোয়ার নিয়ে আসেন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ ভক্তিধর্মে আকৃষ্ট হয়। হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয়ের ফলে শুধু সত্যপিরেরই নয়, ওলাবিবি, গঙ্গাদেবী, শীতলা দেবীর পূজার প্রচলন হয়।
হুসেন শাহি আমলে অর্থনৈতিক অবদান
হুসেন শাহি শাসনকালে বাংলায় শিল্প-বাণিজ্যের যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায়। কৃষিক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটে। কৃষির উন্নতির ফলে উদ্বৃত্ত ফসল রপ্তানি করা হলে বাণিজ্যের অগ্রগতি ঘটে। গৌড়, সপ্তগ্রাম, সেনারাগাঁও, চট্টগ্রাম প্রভৃতি ছিল হুসেন শাহি যুগের বাংলায় বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র। শ্রীলঙ্কা, বষ্মদেশ, ইন্দেনেশিয়া, ইন্দোচিন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে এসময় সমুদ্রপথে। বাংলার বৈদেশিক বাণিজ্য চলত। সে সময় বাংলার উৎকৃষ্ট চিনি, সুতিকাপড়, মসলিন খুব চড়া দামে বিদেশের বাজারে বিক্রি হত। অবশ্য কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতি সত্ত্বেও হুসেন শাহি আমলে সাধারণ মানুষ দারিদ্যের অভিশাপে জর্জরিত ছিল।
সমালােচনা
হুসেন শাহি বংশের রাজত্বের গৌরবের আলােচনার পাশাপাশি এই রাজত্বের বিভিন্ন সমালােচনাও করা হয়ে থাকে। যেমন—
(১) ইতিহাসবিদ ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য অনুসরণে বলা যায় যে, হুসেন শাহ বহু অর্থ ব্যয়ে অসংখ্য যুদ্ধ করলেও তিনি খুব কম যুদ্ধেই পূর্ণ সাফল্য পেয়েছেন।
(২) ড. মজুমদার হুসেন শাহের ধর্মীয় উদারতার বিষয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বৈষব গ্রন্থে উল্লেখ আছে, যে, উড়িষ্যা অভিযানে গিয়ে হুসেন শাহ বহু মন্দির ও দেবমূর্তি ধ্বংস করেছিলেন। চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে হুসেন শাহকে ‘পরম দুর্বার’ ও ‘যবন রাজা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সুলতানের কর্মচারীরা তাকে খুশি করার জন্য প্রতিদিন বহু হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করত বলে পাের্তুগিজ পর্যটক বারবােসা উল্লেক করেছেন।
(৩) ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদারের ধারণা, বাংলা সাহিত্যের প্রকৃত উন্নতি হুসেন শাহের আমলে নয়, তার মৃত্যুর পরে ঘটেছিল। হুসেন শাহের আমলের সাহিত্যের অগ্রগতির সঙ্গে সুলতানের সম্পর্ক ছিল খুবই সামান্য।
মূল্যায়ন
এইসব সমালােচনা সত্ত্বেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদই মনে করেন যে, এই সময় বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, ধর্ম প্রভৃতি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল তা বাংলার পরবর্তী ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিল। হুসেন শাহি শাসনকালকে এককথায় বাঙালি জাতির জাতীয় শাসনকাল’ বলে উল্লেখ করা হয়। ড, যদুনাথ সরকার লিখেছেন যে, “আলাউদ্দিন হুসেন শাহ, মহত্তম না হলেও প্রশ্নাতীতভাবে মধ্যযুগের বাংলার সর্বোত্তম শাসক ছিলেন।”
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .