কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের (১৪৯২ খ্রি.) পর ইংরেজরাই প্রথম সেখানে উপনিবেশ গড়ে তােলে ১৬০৭ খ্রি.)। সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে স্টুয়ার্ট রাজবংশের রাজত্বকালে অ্যাংলিকান স্টুয়ার্ট শাসকগণ পিউরিটানদের পর ধর্মীয় অত্যাচার শুরু করলে তারা ইংল্যান্ড ছেড়ে আমেরিকার বিভিন্ন উপনিবেশে এসে বসবাস শুরু করে। উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ব্রিটিশ আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কর চাপালে উপনিবেশবাসীরা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যা আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম বা আমেরকিার বিপ্লব নামে পরিচিত।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের কারণ
(১) ধর্মীয় বিদ্বেষ :- ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট রাজাদের ধর্মীয় অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে যে ইংরেজরা মাতৃভূমি ছেড়ে আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে এসেছিল, তাদের মধ্যে অনেকেই পিউরিটান ধর্মাবলম্বী ইংরেজের বংশধর। বংশপরম্পরায়। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই পিউরিটানদের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত ছিল। তারা কোনাে মতেই ব্রিটেনের রাজার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে রাজি ছিল না।
(২) জাতীয়তাবােধের উন্মেষ :- কয়েক প্রজন্ম ধরে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পাশাপাশি বসবাস করে একই গির্জায় উপাসনা করে উপনিবেশকারীদের মধ্যে এক ঐক্যবােধ গড়ে উঠেছিল। তারা অনুভব করেছিল ব্রিটিশদের থেকে তাদের অস্তিত্ব আলাদা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মাতৃভূমি থেকে দূরে থাকা এবং আমেরিকাতে নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত থাকায় তারা আমেরিকার জাতীয় চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্দীপ্ত হয়। টমাস জেফারসন উপনিবেশবাসীদের। জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বলেন— স্বাধীনতা বৃক্ষের জন্য গণতন্ত্রের মতাে ওষুধ দরকার।
(৩) দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের অনুপ্রেরণা :- টম, পেইন, টমাস, জেফারসন, লক, * হ্যারিংটন, মিলটন, মন্তেস্কু প্রমুখের দার্শনিক ভাবনা উপনিবেশবাসীর মনে স্বাধীনতার আকাক্ষা জাগিয়ে তােলে। এ ছাড়াও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, জন ওয়াইজ, রজার উইলিয়ামস, জোনাথন মেহিউ প্রমুখ লেখকের উপনিবেশবাসীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এসময়কার হার্ভার্ড, উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি কলেজ, ইয়েলে কলেজ, পেনসিলভানিয়া, কলম্বিয়া, ডার্টমাউথ প্রভৃতি শিক্ষাকেন্দ্রগুলি এবং নিউজ লেটারসহ পঁচিশটি সংবাদপত্র উপনিবেশগুলির স্বাধীনতার সপক্ষে মত প্রকাশ করে।
(৪) সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের প্রভাব :- সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬-৬৩ খ্রি.) ফ্রান্স হেরে যাওয়ায় উত্তর আমেরিকার ফরাসি উপনিবেশ কানাডা ইংল্যান্ডের দখলে আসে। ফলে উপনিবেশবাসীদের মনে থেকে ফরাসি ভীতি দূর হয়। তারা একজোট হয়ে স্বাধীনতা লাভের জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক এডমন্ড রাইটের মতে-ফরাসি ভীতি দূর হওয়ায় আমেরিকার বিপ্লব অনিবার্য হয়ে ওঠে।
(৫) নেভিগেশন আইন ঃ স্টুয়ার্ট রাজা দ্বিতীয় চার্লসের আমলে পাস করানাে নেভিগেশন আইনে (১৬৬০ খ্রি.) বলা হয়-
(১) আমেরিকাতে কোনাে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কলকারখানা গড়ে তােলা যাবে না।
(২) আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশে উৎপাদিত সামগ্রী, যথা—নীল, চিনি, তুলাে, তামাক ইত্যাদি ইংল্যান্ডের জাহাজের মাধ্যমে শুধুমাত্র ইংল্যান্ডেই রপ্তানি করা যাবে।
(৩) ইংল্যাজাত সমস্ত পণ্য সামগ্রীও ইংল্যান্ডের জাহাজের মাধ্যমে আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশে আসবে।
(৪) উপনিবেশগুলিতে তুলােজাত কোনাে দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা চলবে না। বাের্ড অব ট্রেড অ্যান্ড প্ল্যানটেশান’ নামে এক কর্তৃপক্ষের ওপর উপনিবেশ নিয়ন্ত্রণের (১৬৯৬ খ্রি. ও নেভিগেশন আইনে আরও কিছু বিশেষ ধারা যােগ করার অধিকার দান করা হয়। মােলাসেস আইন জারি করে ফ্রান্স স্পেনের অধীনস্থ পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সঙ্গে উপনিবেশগুলির বাণিজ্য বন্ধের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
(৬) সহায়তার পরােয়ানা ঃ সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রচুর আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় জাতীয় ঋণ অত্যধিক বেড়ে যায়। এই আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে ঔপনিবেশিক শাসনব্যয় উপনিবেশবাসীদের কাছ থেকেই আদায় করার নীতি নেয়। ব্রিটিশ। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী লর্ড গ্রেনভিল চোরাচালান বন্ধের জন্য ও রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে সহায়তার পরােয়ানা নামক এক আইন পাস করান (১৭৬৩ খ্রি.)। এই আইনের বলে ইংল্যান্ড বাদে অন্য কোনাে ইউরােপীয় দেশ থেকে সরাসরি কিছু কেনার ওপর উপনিবেশগুলিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এ ছাড়াও এই আইনের সাহায্যে কোনােরকম আগাম সতর্ক না করে উপনিবেশবাসীদের ঘরবাড়ি তল্লাশি চালানাে হত।
(৭) চিনি আইন (১৭৬৪ খ্রি.) :- ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গ্রেনভিল সুগার অ্যাক্ট বা চিনি। আইন জারি করেন। এতদিন ধরে উপনিবেশবাসীর সস্তায় ফরাসি উপনিবেশ কানাডা থেকে যে চিনি ও ঝােলা গুড় আমদানি করত, সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধজয়ের ফলে কানাডা | ব্রিটিশের দখলে আসায় এই আমদানি দ্রব্যের ওপর করের হার ২.৫ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হয়। এর পরােক্ষ প্রভাবে আমেরিকায় মদের দাম বেড়ে যায়, ফলে উপনিবেশবাসীরা ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে।
(৮) স্ট্যাম্প অ্যাক্ট (১৭৬৫ খ্রি.)ঃ রেড ইন্ডিয়ানদের আক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া ও ফরাসিদের থেকে অধিকৃত অঞ্চগুলি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার উত্তর আমেরিকায় দশ হাজার সেনা মােতায়েন করে। এইসব ব্রিটিশ সেনার মােট খরচের এক তৃতীয়াংশ তােলার লক্ষ্যে গ্রেনভিল মন্ত্রীসভা স্ট্যাম্প অ্যাক্ট জারি করে। এই আইনে বলা হয় আমেরিকার সমস্ত দলিলপত্র, চুক্তিপত্র ও লাইসেন্স-এ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে কেনা স্ট্যাম্প লাগাতে হবে, নতুবা তা আইনানুগ হবে না। এই কালা আইনের বিরুদ্ধে বােস্টনের আইনজীবী জেমস ওটিস বলেন- যেহেতু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকার কোনাে প্রতিনিধি নেই, তাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ধার্য করা কোনাে কর দিতে আমেরিকানরা বাধ্য নয়।
(৯) ঘােষণার আইন (১৭৬৬ খ্রি.) : পরবর্তী ব্রিটিশ প্রধামন্ত্রী রকিংহ্যাম স্ট্যাম্প অ্যাক্ট প্রত্যাহার করে নেন। রকিংহ্যাম মন্ত্রীসভার রাজস্বমন্ত্রী চার্লস টাউনসেন্ট জারি করেন ঘােষণার আইন। এই আইনে বলা হয় উপনিবেশবাসীদের ওপর কর ধার্যের অধিকার রয়েছে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের। এই আইন অনুসারে আমেরিকার উপনিবেশগুলিতে আমদানি করা চা, চিনি ও কাচের ওপর কর চাপানাে হয় (১৭৬৭ খ্রি.)। এই ঘােষণার আইনের বিরুদ্ধে উপনিবেশবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।
(১০) বােস্টন টি পার্টি :- আমেরিকরা ১৩টি উপনিবেশ জুড়ে বিভিন্ন করের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠলে পরবর্তী প্রধামন্ত্রী লর্ড নর্থ সমস্ত কর প্রত্যাহার করে নেন। (১৭৭০ খ্রি.) কিন্তু উপনিবেশবাসীদের ওপর mother country ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যে কর চাপানাের অধিকার রয়েছে তা বােঝানাের জন্যই তিনি শুধুমাত্র চায়ের ওপর পাউন্ড প্রতি ৩ পেনি কর বহাল রাখেন। এর প্রতিবাদস্বরূপ স্যামুয়েল অ্যাডামসের নির্দেশে বেশ কিছু উপনিবেশবাসী রেড ইন্ডিয়ানের ছদ্মবেশে এক রাতে (১৬ ডিসেম্বর, ১৭৭৩ খ্রি.) ডার্টমাউথ নামক জাহাজে উঠে ৩৪২ পেটি চা সমুদ্রের জলে ফেলে দেয়। এই ঘটনা বােস্টন টি পার্টি নামে পরিচিত। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ সরকার বােস্টন বন্দর বন্ধ করে দেয় ও বিভিন্ন দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে যা স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি গড়ে দেয়।
(১১) স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র :- ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার উপনিবেশগুলি ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে। জর্জিয়া ছাড়া আমেরিকার ১২টি উপনিবেশের ৫১ জন প্রতিনিধি ফিলাডেলফিয়া শহরে এক অধিবেশনে মিলিত হন (১৭৭৪ খ্রি. ৫ সেপ্টেম্বর)। এই অধিবেশনেই ইংল্যান্ড-রাজ তৃতীয় জর্জের কাছে আমেরিকাবাসীদের বিভিন্ন সমস্যার প্রতিকারের আবেদন জানানাে হয়। কিন্তু তৃতীয় জর্জের কাছে উপনিবেশবাসীদের সব আবেদন ব্যর্থ হয়। ব্রিটিশ সৈন্যরা বােস্টনের কাছে লেক্সিংটন। ও কনকর্ড নামক জায়গায় গুলি চালানাের ফলে বিদ্রোহের আগুন তীব্রতর হয়ে ওঠে। উপনিবেশবাসীরা জর্জ ওয়াশিংটনকে তাদের সেনাপতি নির্বাচিত করে টমাস জেফারসর রচিত ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘােষণা করে (১৭৭৬ খ্রি., ৪ জুলাই)। অবশেষে ভার্সাই সন্ধির মাধ্যমে ব্রিটিশ আমেরিকার উপনিবেশবাসীদের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়।
উপসংহার :- আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে উপনিবেশবাসীদের সঙ্গে হল্যান্ড, ফ্রান্স ও স্পেন যােগ দিয়েছিল। কেন না উপনিবেশবাসীদের মধ্যে মুষ্টিমেয় বাসিন্দার উৎসভূমি ছিল এইসব দেশগুলি। ব্রিটিশ সেনাপতি কর্নওয়ালিশের আত্মসমর্পণে ও জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, আলেকজান্ডার হ্যামিলটন, জন। অ্যাডামস প্রমুখের সুদক্ষ নেতৃত্বের গুণে আমেরিকাবাসী স্বাধীনতার সূর্যোদয় প্রত্যক্ষ করল। স্বাধীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি হলেন ‘জাতির জনক’ জর্জ ওয়াশিংটন।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .