নীল বিদ্রোহ এর কারণ ও ফলাফল
বিদ্রোহের উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল ১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দে কালােরােয়ার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হেমচন্দ্র কর-এর একটা নির্দেশ। তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন যে, রায়তের অধিকারে যেন কেউ হস্তক্ষেপনা করে।রায়ত তার জমিতে খুশিমতাে যে-কোনাে শস্য উৎপাদন করতে পারবে। এই নির্দেশ নীল চাষিদের মনে যথেষ্ট উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল নদিয়া জেলার গােবিন্দপুর গ্রামে। এই গ্রামের কৃষকরা চৌগাছার দিগম্বর ও বিচরণ বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলচাষ করবে না বলে শপথ নেয়। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।
নীলকরদের অত্যাচার
নীল বিদ্রোহের প্রধান কারণ নীল চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অমানুষিক অত্যাচার। নীলকররা ছিল প্রচন্ড লােভী ও নির্মম অত্যাচারী। দু-রকম জমিতে নীলচাষ হত; ‘এলাকা চাষ’ রায়তি চাষ। এলাকা চাষ ছিল নীলকরদের নিজস্ব জমিতে। আর রায়তি চাষ হত কৃষকদের জমিতে।নীলচাষ নিয়ে সমস্ত অত্যাচারের উৎস ছিল রায়তি চাযে, সেখানে নীলকররা চাষিদের দাদন নিয়ে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। ১৮০১ সালের ৫ই মে তারিখের বাের্ড অফ রেভেনিউ-এর কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় যে, দাদন পদ্ধতি ছিল সমস্ত অত্যাচারের মূলে। চাষিরা ছিল অধিকাংশ গরিব। দাদনের এককালীন টাকা প্রাপ্তী তাদের কাছে ছিল আকর্ষণীয়। প্রথমদিকে দাদনের পরিণাম বুঝতে পেরে অনেকেই দাদন গ্রহণ করত। কিন্তু একবার দাদনের ফাস গলায় পরলে তাদের অবস্থা হত প্রায় ভূমিদাসের মতাে। এই থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিল।
দাদন গ্রহণের ভয়ংকর পরিণতির কথা চিন্তা করে কেউ দাদন গ্রহণে অসম্মত হলে তাকে বাধ্য করা হত দাদন নিতে। অবাধ্যচাষিকে নীলকুঠিতে এনে প্রচন্ড অত্যাচার করা হত। তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিত নীলকররা। অত্যাচার করত চাষির স্ত্রী-কন্যাদের উপর। নীলদর্পণ নাটকে দীনবন্ধু মিত্র নীল চাষিদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ভয়াবহ বর্ণনা দিয়ে গেছেন। নীলকদের অত্যাচারে সমস্ত দেশ পরিণত হয়েছিল সন্ত্রাসের বিভীষিকার রাজত্বে। কমে গিয়েছিল ধানের উপযুক্ত জমি। ফলে চাষির ঘরে ঘরে দেখা দেয় অন্ন কষ্ট।
নীলকরদের সরকারি সমর্থন
সরকারি আইন ছিল নীলকরদের পক্ষে। ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে যষ্ঠ আইন দাদন দেওয়াকে আইন সিদ্ধ করে দিল। ১৮৩০ খিস্টাবে পঞ্চম আইনে বলা হয়, দাদন নিয়ে নীলচাষনা করলে তা বে-আইনি হবে। বিচারে কারাদণ্ড অবধারিত। এই আইন ছিল নীলকরদের পক্ষে। চুক্তি ভঙ্গ করলে নীলকররা নিজস্ব পেয়াদা ও লাঠিয়াল পাঠিয়ে রায়তদের উপর অত্যাচার করত।
দস্তুরি প্রথা
নীলকরদের অত্যাচার ছাড়াও নীলচাষিরা শোনিত হত অন্যভাবে। উৎপাদিত নীল কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হত। নীলকররা নীল ওজন করার সময় প্রতারণা করত। প্রতিবাদ করতে সাহস করত না নীল চাষিরা। নীলের দাম দেওয়ার সময় দাদনের কিস্তি ও সুদের টাকা কেটে রেখে দেওয়া হত। নীলকুঠির কর্মচারীর চাশিদের কাছ থেকে নাদাল করত ‘দস্তুরি’। গভর্ণর গ্রান্টও স্বীকার করেছিলেন যে, নীলচাষিদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার ফলে নানান সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ তিনি নিজে হাজার হাজার কৃষকের আবেদনে সাড়া দিয়ে তাদের রক্ষার ব্যবসা করতে পারেননি।
নীলচাষিদের অসহায় অবসথা ঃ নীলচাষিদের অবস্থা আরও করুণ হয়েছিল সরকারি বিচার ব্যবস্থায়। নীলকরদের বিরুদ্ধে চাষিদের নালিশ জানাবার উপায় ছিল না। কারণ মফঃস্বলে তারা ছিল সমস্ত আইনের উদ্দে। মফঃস্বলে ভারতীয় বিচারকরা শেতাদের। বিচার করতে পারত না। তাদের সে অধিকার ছিল না। অথচ কলকাতায় এসে চাষিদের পক্ষে নালিশ করা বা বিচার পাওয়া অসম্ভব ছিল। সমস্যা আরও তীব্র হয়ে ওঠে যখন গভর্ণর হ্যালিডে অনেক নীলকর সাহেবকে অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত করলেন। তখন নীলকর সাহেবরা রক্ষক হিসেবে ভক্ষক হয়ে উঠল।
উপসংহার
নীল বিদ্রোহকে ভারতের অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করে এর কিছু স্বতন্ত্র গুরুত্বের উপর আলােকপাত করা যায়।
১) কৃত্রিম নীল আবিস্কৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় নীলচাষবন্ধ হয়ে গিয়েছিল এমন মনে করা ভুল। নীল চাষিদের বিরােধিতা নীলকর সাহেবদের বাধ্য করেছিল বাংলায় নীলচাষবন্ধ করতে।
২) নীল বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক ঐক্যের পরিচয় দিতে পেরেছিল বলে এই কৃষক বিদ্রোহ এমন সুগঠিত ও সুসংহত হয়ে ওঠে। শুধু হিন্দু-মুসলমান কৃষক সম্প্রদায়ই নয়, নিজেদের স্বার্থেহলেও বেশ কিছু জমিদার, ব্যবসায়ী তালুকদার ও পত্তনিদার নীল বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল এবং বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।
নীল চাষিরা অসাধারণ নৈতিক শক্তিকে আশ্রয় করে এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই শক্তি পরবর্তীকালে অসহযােগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্যরুপে পরিগণিত হয়। লর্ড ক্যানিং মহাবিদ্রোহের থেকেও নীল বিদ্রোহকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। একথা উল্লেখযােগ্য যে, কোম্পানির শাসনের অবসানের পর নীল বিদ্রোহই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রথম গণবিদ্রোহ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .