চিনকেন্দ্রিক বীক্ষা (Sino Centrism)
প্রাচীন কাল থেকে চিনা শাসকেরা এই ধারণা প্রচার করে এসেছেন যে চিনদেশ বিশ্বের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত, আর অন্যান্য সব দেশই তার সীমানার বাইরে রয়েছে। চিনা ভাষায় এই বীক্ষার নাম চুংকুও বা ‘কেন্দ্রীয় রাজ্য’ (Central Kingdom) অথবা মধ্যরাজ্য (Middle Kingdom)। এই ধারণা অনুযায়ী চিনা সভ্যতা বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আর অন্য দেশের অধিবাসীরা ‘দূরের মানুষেরা’ (Men form afair) ‘বর্বর’। চিনের সম্রাট বা হুয়াংতি (Hungati) ই সারা বিশ্বের একমাত্র আইনসিদ্ধ সম্রাট।
চিনের শাসকশ্রেণীর দিক থেকে বিচার করলে এই ধারণা জনমানসে প্রতিষ্ঠা করার পিছনে যুক্তি ছিল। আমরা যদি চিনদেশের সুবিশাল আয়তন ও জাতিগত বিভিন্নতার কথা মাথায় রাখি, তবে বুঝতে পারব বিপুল দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং তাদের মধ্যে জাতীয় সত্তা গড়ে তোলার জন্য এই ধরনের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এটা শুধু দেশের উপর শাসকবর্গের সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সাহায্য করে তাই নয়, একই সঙ্গে তা পাশ্ববর্তী দেশগুলির উপর চিনের আগ্রাসী আধিপত্য কায়েম করার ক্ষেত্রেও বৈধতা দেয়। কিন্তু এই ধারণা অজান্তেই চিনাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহাসিক বিকাশেরও ক্ষতি করে। যে দেশের শাসকশ্রেণী মনে করে যে তারাই বিশ্বে সর্বশ্রেষ্ঠ, তাদের তো তাহলে আর প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করার কোন দরকার থাকতে পারে না। সমাজ বিজ্ঞানী যোসেফ নীডহ্যাম তাই লিখেছেন, এই জন্যই চিনদেশে তুলনামূলক ইতিহাস জ্ঞানের শাখা হিসাবে বিকাশলাভই করতে পারেনি। পরবর্তীকালে এই বীক্ষা সাংস্কৃতিক থেকে উদ্ভূত, ফলে তাদের যে কোন নিজস্ব, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি থাকতে পারে, তাকেই অস্বীকার করা হল। চিনকেন্দ্রিক এই বীক্ষা হল আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈষম্যের এক মডেল। পূর্ব এশিয়ায় চিনা প্রাধান্যের এই মডেল বহুদিন কার্যকরী ছিল। পরে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চিং / মাঞ্জুবংশ দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং পশ্চিমী ও জাপানী অনুপ্রবেশ তীব্র হওয়ার পর থেকেই বীক্ষা তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।
চিনকেন্দ্রিক এই বীক্ষা অনুযায়ী কনফুসিয় নীতি ও আচারবিধি দ্বারা সংহত চিনের এই স্বর্গীয় সাম্রাজ্য বিশ্ব সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু এবং চিনের সম্রাটই বিশ্বের একমাত্র আইনসিদ্ধ শাসক। চিনের প্রতবেশী রাজ্যগুলি— জাপান, কোরিয়া বা ভিয়েতনাম হল অনুগত (vassa) রাজ্য। এই রাজ্যগুলি চিনা সম্রাটকে নজরানা দেবে আর তার বিনিময়ে কিছু সুযোগ সুবিধা এবং পদ পাবে। একমাত্র চিনের শাসককেই ‘সম্রাট’ বলে অভিহিত করা যাবে, যিনি ‘ঈশ্বরের সন্তান’ (Son of Heaven) এবং বরপুত্র। প্রতিবেশী রাজ্যের শাসকেরা ছোট উপাধি পাওয়ার অধিকারী যেমন রাজা বা ওয়ান (Wan)। চিন বহির্ভূত রাজ্যগুলির অধিবাসীদের ‘বর্বর’ নামে অভিহিত করা হত।
চিনকেন্দ্রিক এই বীক্ষার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। একটি হল সভ্যতার মর্মকেন্দ্রকে চিহ্নিত করা, আর অপরটি হল শাসক বংশের উত্তরাধিকারকে বৈধতা দেওয়া। শুরুতে উত্তর চিনের সমতলভূমিকে – যেখানে সুপ্রাচীন চিনা সভ্যতার সূত্রপাত — মর্মকেন্দ্ৰ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, সেই অঞ্চল বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। এখানে যা উল্লেখের দাবি রাখে তা হল, চিনকেন্দ্রিক এই বীক্ষা সর্ববৃহৎ হান (Hun) জাতিসত্তার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ছিল না। উত্তর চিনের বিভিন্ন জাতিসত্তার শাসকেরা বিভিন্ন সময়ে দেশের শাসক হয়েছেন – যেমন জিয়ানবেই, জুরচেন বা মাঞ্চু দক্ষিণ ও উত্তর বংশের রাজত্বকালে দক্ষিণ চিনের হান চিনদের রাজত্বকে ‘বর্বরদের রাজত্ব নামে অভিহিত করা হত, কারণ তারা জিয়ানবে শাসনকে অস্বীকার করেছিল। একইভাবে মাঞ্চু বংশও ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয় বণিকদের আগমনকে ‘বর্বরদের আগমন বলে অভিহিত করে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .