ভূমিকা ঃ ষােড়শ শতাব্দীতে খ্রীষ্টীয় চার্চ ও ধর্মব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইউরােপের দেশগুলিতে যে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল, তাকেই সাধারণভাবে ‘রিফরমেশন বা ‘ধর্মসংস্কার আন্দোলন’ বলা হয়। তবে এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত খ্রীষ্টীয় চার্চের বা প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার নিছক সংস্কারধানের লক্ষ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই আন্দোলনের পরিণতিতে রােমান চার্চের একাধিপত্য ভেঙে গিয়েছিল। গড়ে উঠেছিল। জাতিভিত্তিক একাধিক চার্চ। তাই এই উদ্যোগকে কেউ কেউ ধর্মসংস্কার আন্দোলন না বলে ধর্মবিপ্লব’ নামে অভিহিত করার পক্ষপাতী। যাইহােক, ক্যাথলিক চার্চের অনাচারের বিরুদ্ধে জনমানসে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকেই এই আন্দোলনের উদ্ভব ঘটেছিল।
পটভূমি :- মধ্যযুগে ‘পােপতন্ত্র ছিল একটি সর্বশক্তিমান সংস্থা। মহান পিটারের উত্তরাধিকারী ও ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পােপ ছিল সমগ্র খ্রীষ্টানজগতের একচ্ছত্র অধিপতি। সমগ্র পশ্চিম-ইউরােপ বিনা প্রশ্নে পােপতন্ত্রের এই কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছিল। রাজা বা জনগণ সবাই ছিলেন পােপতন্ত্রের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে পােপ ছিলেন সমস্ত নিয়ন্ত্রণের উর্ধ্বে ঈশ্বরের সাথে মানুষের যােগাযােগ একান্তভাবেই নির্ভর করত পােপের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। পােপের এহেন দাবি অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জনগণ মেনে নিতে স্বাভাবিক কারণেই। অপার্থিব ক্ষমতার পাশাপাশি খ্রীষ্টান চার্চ তথা পােপ পার্থিব ক্ষমতাও দাবি করত। যেমন—রাজার অভিষেক পােপের স্বীকৃতি ছিল বাধ্যতামূলক। আইনবিধি রচনায় পােপের সম্মতি নিতে রাজা বাধ্য ছিলেন। কোন রাজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকারও পােপ তার বৈধ অধিকার বলে দাবি করতেন।
(১) পােপতন্ত্রের দুর্নীতি :- ষােড়শ শতকের গােড়ায় পােপতন্ত্রের দুর্নীতি চরমে পৌছেছিল। সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী চার্চগুলি সীমাহীন অনাচার ও আখড়ায় পরিণত হয়েছিল। তখন ভূমি-সম্পদের সিংহভাগ ছিল চার্চের অধীনে। বিশাল। সম্পত্তির অধিকারী যাজক সম্প্রদায় ক্রমেই বাস্তুবাদীও বিলাসপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলি হয়ে উঠেছিল আড়ম্বপূর্ণ। যাজকগণ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। ধর্মের নামে উৎকোচ গ্রহণ করতেও দ্বিধাবােধ করতেন না। যাজক ও সন্ন্যাসীগণ । নৈতিকতাবর্জিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। যাজকপদে থেকেও বিবাহ করা, পরস্ত্রীগমন, মদ্যপান ও অন্যান্য ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা তখন ছিল খুবই স্বাভাবিক।
(২) যাজকদের অনৈতিক জীবন :- সর্বশক্তিমান চার্চ ও পােপ খ্রীষ্টীয় মঠ। সন্ন্যাসীদের এই চারিত্রিক কলুষতা বা স্থলনকে নিন্দা বা রােধ করার পরিবর্তে সমর্থন করতে থাকে। চার্চের নির্দেশেই জনগণ চার্চের হাতে ধর্ম-কর (টাইথ), বাৎসরিক কর (এ্যানেট), জন্মকর, মত্যুকর ইত্যাদি নানা প্রকার কর তুলে দিতে বাধ্য হত। এর উপরে ছিল ‘ইন্ডাজেন্স’ বা ‘মার্জনাপত্র’ নামক অর্থ আদায়ের এবং অভূতপূর্ব ব্যবস্থা। যে-কোন মানুষ তার অপরাধের জন্য নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে পােপের কাছ থেকে ‘মার্জনাপত্র ক্রয় করতে পারত। এই পত্র ক্রয় করলে তার পাপস্খলন হয়ে যেত। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী মৰ্জনাপত্রের মূল্য কমবেশী হত। ধর্মের নামে এই অধর্মের বেসাতির কেন্দ্র হিসেবে চার্চ এবং তার প্রধান পরিচালক হিসেবে পােপতন্ত্রের উপর ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টানরা ক্রমেই শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন।
(৩) প্রথম প্রতিবাদ :– চার্চ ও পােপতন্ত্রের দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত অঅসে চতুর্দশ শতকের মধ্যমপাদে। ইংল্যাণ্ডের জন ওয়াইক্লিফ (১৩২০-৮৪ খ্রীঃ) এবং বােহেমিয়ার জন হাস্ (১৩৭১-১৪১৫ খ্রঃ) চার্চের বিরুদ্ধে প্রথম সােচ্চার হন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও চিন্তাবিদ ওয়াক্লিফ ঘােষণা করেন যে, ঈশ্বরলাভের জন্য পােপের মধ্যস্থতা নিষ্প্রয়ােজন। প্রতিটি মানুষ নিজ কর্মের দ্বারাই ঈশ্বরের কাছে। পৌছাতে পারে। তিনি প্রচার করেন, ঈশ্বরের রাজ্যে সকল মানুষই সমান। ধর্মের মূলতত্ত্ব মানুষের কাছে পৌছে দেবার জন্য তিনিই প্রথম বাইবেলের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করেন। তার আহ্বানে সারা দেশে চার্চবিরােধী চেতনা জাগরিত হয়। এজন্য তাকে ‘সংস্কার আন্দোলনের শুকতারা’ বলা হয়। ওয়াইক্লিফের অনুগামীরা ‘লােলার্ড’ নামে পরিচিত হন। তাঁর ভাব-শিষ্য এবং প্রাগ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হাস গীর্জার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালাতে থাকেন। ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ পােপ এবং যাজক সম্প্রদায় অমানবিক নৃশংসতা দ্বারা জনকে পুড়িয়ে মারেন এবং তার অনুগামীদেরও নিশ্চিহ্ন করতে থাকেন। অবশ্য এতদসত্ত্বেও তারা সত্যের বাণীকে রুদ্ধ করতে পারেনি।
(৪) নগরের উদ্ভব :- ষােড়শ শতকের অর্থনৈতিক তৎপরতা, ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার এবং নগরজীবনের উদ্ভব ধর্মসংস্কারের পথ প্রশস্ত করে দেয়। মধ্যযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজজীবনে প্রচলিত ধর্মের প্রভাব ছিল প্রশ্নহীন। দরিদ্র ও মূর্খ মানুষ চার্চ বা পােপের নির্দেশ অভ্রান্ত বলে মেনে নিত। ক্রমে শিল্প-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ও নগরের পত্তন মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে রূপান্তর ঘটায়। মানুষ ক্রমশ বস্তুকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। অন্ধের মত পােপতন্ত্রের নির্দেশ মানতে তারা অস্বীকার করে। নগর-সভ্যতা বয়ে আনে শিক্ষার মুক্ত হাওয়া। মানুষ যুক্তিবাদী হয়ে উঠলে স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মের বন্ধন শিথিল হতে থাকে।
(৫) জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব : ধর্মসংস্কার আন্দোলনের আর একটি ইতিবাচক প্রেক্ষাপট রচনা করে জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান। শক্তিশালী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তি বা গােষ্ঠীর নেতৃত্বে যােড়শ শতকে গড়ে ওঠে। একাধিক জাতীয় রাষ্ট্র। জাতীয় রাজতন্ত্র সংঘবদ্ধতা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে চার্চের বাইরে এবং সম্ভবত উর্ধ্বে থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে সংকল্পবদ্ধ হয়। এদের কাছে পােপ ছিলেন বিদেশী এবং পােপতন্ত্র ছিল রাজকীয় ঐক্যের পরিপন্থী। এই সকল রাজ্য ইতালীর চার্চের কর্তৃত্বের পরিবর্তে নিজস্ব জাতীয় চার্চ প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজনীয়তা উপলদ্ধি করে।
এইভাবে নগর-সভ্যতার বিকাশ ও জাতীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা প্রচলিত ধর্মব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করতে উদ্যত হয়। ওয়াইক্লিফ, জন হাস, লরেঞ্জো ভাল্লা, রিউক্লিন প্রমুখ সংস্কারকের প্রতিবাদ বহুগুণ বেশী শব্দে ধ্বনিত হয় মার্টিন লুথার-এর কণ্ঠে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .