নৌবিদ্রোহ
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের নৌবাহিনীর বিদ্রোহ ভারতের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বােম্বাই বন্দরের তলােয়ার” নামে একটি জাহাজের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে নৌ-সেনারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেষ পর্বের সূচনা করে।
নৌবিদ্রোহের কতকগুলি কারণ
প্রথমতঃ আজাদ হিন্দ বাহিনীর আত্মত্যাগ ও সাহস ভারতীয় সেনাদের মনেও এক ধরণের। জাতীয়তাবােধ জাগরিত করেছিল।তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই নৌবিদ্রোহ।
দ্বিতীয়তঃ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ নৌবিদ্রোহের অর একটি কারণ। ভারতীয় নৌসেনাদের সঙ্গে ব্রিটিশ অফিসাররা অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করত।
তৃতীয়তঃ সমযােগ্যতা থাকলেও ভারতীয় নৌকর্মচারীদের কখনােই ব্রিটিশ কর্মচারীদের সমান বেতন দেওয়া হত না। এই বৈষম্যে ভারতীয় নৌসেনারা ক্ষুদ্ধ হয়।
চতুর্থতঃ ভারতীয় নাবিকদের যে খাদ্য দেওয়া হত তা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। বহুবার ভালাে খাবারের আবেদন করেও কোনাে সুরাহা হয়নি। ফলে তারা বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়।
পঞ্চমতঃ ভারতীয় নৌ-সেনাদের উপযুক্ত বসবাসের ব্যবস্থা ব্রিটিশ অফিসাররা করত না তারা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করত।
যষ্ঠতঃ ইন্দোনেশিয়ায় প্রেরিত ভারতীয় নাবিকদের প্রত্যাবর্তনের দাবি জানানাে হয়। আসলে কাম্পুচিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মায়ানমারে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে গণ আন্দোলন গড়ে ওঠে ভারতীয় সেনাদের ওপরও তার প্রভাব পড়েছিল।
নৌবিদ্রোহের সূচনা
বােম্বাই বন্দরে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির তলােয়ার’নামক জাহাজের রেডিও অপারেটর বলাই দত্ত তার ক্যাবিনে জাতীয় স্লোগান লেখার অপরাধে পদচ্যুত হন। এর প্রতিবাদে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান সিগন্যালমেন এম.এস. খানের নেতৃত্বে ১৫০০ নাবিক বিদ্রোহ ঘােষণা করে (১৮ই ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৬)।
নৌবিদ্রোহের বিস্তৃতি
১৯ শে ফেব্রুয়ারী বােম্বাইয়ের নৌবাহিনীর মাল্লা পদাধিকারীরা সংকেত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে বিদ্রোহ শুরু করে। এখানে ষাটটি জাহাজের মাল্লারা বিদ্রোহে অংশ নেয়। বিদ্রোহীরা ব্রিটিশ পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক’নামিয়ে জাহাজে কংগ্রেস, লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির তিনটি পতাকা তুলে দেয় এবং রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভী’র নাম রাখে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভী’। তারা ঘােষণা করে যে, জাতীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া তারা অন্য কারাে আদেশ মানবে না। ক্ৰমশঃ বিদ্রোহের আগুন মাদ্রাজ, কলকাতা ও করাচি বন্দরে ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য গঠিত হয় ‘কেন্দ্রিয় নৌ ধর্মঘট কমিটি। এই কমিটির সভাপতি হন এম.এস, খান এবং সহসভাপতি হন টেলিগ্রাফিস্ট মদন সিং। বােম্বাই-এর বিদ্রোহীরা কংগ্রেস, লীগ ও কমিউনিস্টদের পতাকা নিয়ে জয় হিন্দ’, ইনক্লাব জিন্দাবাদ’ প্রভৃতি ধ্বনি নিয়ে রাস্তায় মিছিল বের করে। বােম্বাই-এর বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করে।
নৌবিদ্রোহের অবসান
২১ শে ফেব্রুয়ারী ব্রিটিশ সেনা বাহিনী সরাসরি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নামে। সাত ঘণ্টা ধরে দুপক্ষে লড়াই চলল। বােম্বাইয়ের রাজপথ রক্তাক্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে নৌসেনাপতি গডফ্রে গােলাবর্ষণ করে বােম্বাই শহর ধ্বংসের হুমকি দিলে কংগ্রেস নেতা সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল দু’পক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা শুরু করেন এবং প্যাটেলের নির্দেশে বিদ্রোহীরা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেন। বিদ্রোহীরা ঘােষণা করে “We Surrender to India not to Britain.”
মূল্যায়ণ
নৌবিদ্রোহের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। সিপাহী বিদ্রোহের পর এতবড় বিদ্রোহ ভারতের অভ্যন্তরে আর কখনও সংঘটিত হয়নি। এই বিদ্রোহের ফলে ইংরেজ সরকার স্পষ্টতই বুঝতে পারে যে ভারতের তাদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। তাই ব্রিটিশ প্রশাসন শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .