ভূমিকা :- যােড়শ সপ্তদশ শতকে ইউরােপের ধর্মীয় জীবনে সংস্কারবাদী চেতনা প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় সংগঠনের মূলে আঘাত করার সঙ্গে সঙ্গে একটি বহুমুখী সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এই ঘটনা ইতিহাসে ইউরােপের ধর্ম-সংস্কার বা Reformation নামে অভিহিত হয়। ধর্ম-সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন মার্টিন লুথার।
৯৫-থিসিস :– জার্মানীর স্যাক্সনীতে ১৪৮৩ খ্রীষ্টাব্দে মার্টিন লুথারের জন্ম হয়। ১৫১০ খ্রীষ্টাব্দে রােম থেকে ফেরার পর তিনি পােপ ও কার্ডিনালদের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেন। লুথারকে কেন্দ্র করে একদল মানুষ সংগঠিক হন। লুথারবাদ’ নামে একটি প্রতিবাদী মতবাদ জন্ম নেয়। লুথারের প্রতিবাদ চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে যখন তিনি উটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় ৯৫টি প্রশ্ন রচনা করে পােপকে জবাব দেওয়ার জন্য একটি কাগজ সেটে দেন। জার্মানী স্বীকৃত সম্প্রদায় লুথারের এই প্রশ্নাবলী দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। লুথারের মতবাদকে কেন্দ্র করে জার্মানীতে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করে।
আর্থিক পটভূমি :- জার্মানীতে সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশের প্রেক্ষাপটে জার্মানীর আর্থ-সামাজিক অবস্থানটি গুরুত্বপূর্ণ। ষােড়শ শতকের গােড়ায় জার্মানী ছিল। আর্থিক সমৃদ্ধি ও জনসংখ্যার বৃদ্ধির মূল কেন্দ্র। ১৩-১৪ শতকে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ও কৃষি-সংকট শহরগুলির উত্থান দ্রুততর করেছিল। উত্তরের শহরগুলির ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করত বাল্টিক ও উত্তর সাগর এবং দক্ষিণের শহরের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত আল্পস। পর্বতমালার অপর পাড়ে অবস্থিত ইতালী। লক্ষণীয় যে ইউরােপীয় অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকলেও জার্মানীকে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক, ‘Unit বলা যায় না। এখানে সম্রাটের কোন ক্ষমতা ছিল না। সীমান্ত অঞ্চলগুলি কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিল। শহরের আর্থিক ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রিত হত সমবায় সংগঠন বা Guild দ্বারা। কৃষকদের অবস্থা ছিল শােচনীয়। এই সুবাদে মঠগুলি কৃষকদের। উপর ধর্মীয় করের চাপ বাড়াতে থাকে। এর প্রতিবাদে উটেনবার্গ, স্টিরিয়া প্রভৃতি স্থানে যাজকদের বিরুদ্ধে কৃষক-বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। জার্মানীতে চার্চের অবস্থাও ছিল সঙ্গীন। যাজকেরা ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে সাধারণ মানুষ চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। G. R. Elton বলেছেন, ১৪ শতকে চার্চ, মহামারী, যুদ্ধ ও আর্থিক সংকট দ্বারা যে আঘাত পেয়েছিল ১৫ শতকে তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। মননশীলতার ক্ষেত্রে মানুষের উপর চার্চের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়েছিল। এর পাশপাশি গণমুখী ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব জার্মানীতে মিষ্টিক ঐতিহ্যকে দ্রুত শক্তিশালী করেছিল। ইতালীর মানবতাবাদ ছিল তার বহিঃপ্রকাশ। Scribner-এর মতে, জার্মানীর সংস্কার আন্দোলন রাষ্ট্রীয় জীবনের সাথে সম্পর্ক চিহ্নিত করে। জার্মানীর রাজন্যদের সমর্থন এবং যাজকদের নিয়ন্ত্রণ করার বাসনা লুথারবাদকে সাহায্য করেছিল।
সামাজিক পটভূমি : তবে শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করা যায় না। তবে এই প্রসঙ্গে জর্মানীতে উচ্চশিক্ষার প্রসারের দিকটি গুরুত্বপূর্ণ। পঞ্চদশ শতকের শেষ থেকে জার্মানীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মানবতাবাদী পণ্ডিতের সমাগম ঘটছিল। উদার চিন্তাধারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের অন্যান্য স্তরে। ফলে ধর্মীয় জীবনে সংস্কারের আবশ্যিকতা সম্পর্কে জার্মানীর শিক্ষিত সমাজে একটি আগ্রহ জোরালাে হয়েছিল। তাই পনেরশাে কুড়ির দশকে লুথারের প্রতিবাদী ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে যে আলােড়নের সৃষ্টি হয় তা সহজে শিক্ষিত মানুষের সমর্থন লাভ করে।
মতাদর্শ :- লুথারে সংস্কারপন্থী মতাদর্শে কেন্দ্রের ছিল দুইটি তত্ত্ব। –
(ক) সবাই নিজের পুরােহিত এবং (খ) ঈশ্বর বিশ্বাসই মুক্তির একমাত্র পথ।
লুথার ঘােষণা করেন ঈশ্বরের সঙ্গে সংযােগের জন্য ধর্মবিশ্বাসী মানুষের কোন মধ্যবর্তীর প্রয়ােজন নেই। প্রত্যেকেই নিজেই নিজের পুরােহিত। মৰ্জনাপত্র (indulagence)-এর বিরােধিতা প্রসঙ্গে লুথার বলেন, পুর্ণ লাভের জন্য কোন দান-ধ্যান, আচার-অনুষ্ঠান নিষ্প্রয়ােজন। করুণাময় ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস রাখলেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। উটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে তার বিভিন্ন বক্তব্য ও বিশ্লেষণের ভিত্তিতে অনেকেই তাকে মানবতাবাদী পণ্ডিত বলে মনে করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মার্টিন লুথার প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সােচ্চার হলেও ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন অতি ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। জ্ঞান চার্চের পাশাপাশি তার ধর্মবিশ্বাসী মন লুথারের চরিত্রে এক বিচিত্র ধরনের স্ববিরােধিতার প্রবণতা সৃষ্টি করেছিল। দৈব ও মানবজীবনের সম্পর্কে এই পরস্পরবিরােধী ধারণা লুথারের ধর্মতত্ত্বে সমবিষ্ট ছিল। একদিকে তার ধর্ম বিশ্বাস থেকে তিনি মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য হিসাবে ঈশ্বরের অনুগম করার কথা বলেন। অন্যদিকে তার বিশ্বাস ছিল মানুষ এমন একটা জগতের অধিবাসী যেখানে জীবনের প্রয়ােজনে ঈশ্বর থেকে যে বিচ্ছিন্ন। মানুষের অস্তিত্বের একদিকে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনযাত্রা এবং অন্যদিকে বিশ্বাসের জগৎ। ঈশ্বর ও মানুষের এই বিচ্ছিন্ন অবস্থান-বিষয়ক দর্শনতত্ত্ব Occamism-এর সঙ্গে তার বিশেষ যােগ ছিল।
লুথারের ধর্মতত্ত্ব এই বিচ্ছিন্নতা দূর করতে চেয়েছিল। এই ভিত্তি থেকে মুক্তির প্রয়ােজনে তিনি ঈশ্বর ও মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে চর্চা শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত একজন পণ্ডিতের মননশীলতা থেকে Occamism-এর বিরােধীতা করেন। তিনি বলেন, ঈশ্বরে বিশ্বাস মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে সংযােগ রক্ষা করে। ঈশ্বরের প্রতি নিঃসংশয়চিত্তে বিশ্বাসী থাকলেই মানুষের মুক্তি সম্ভব। সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি ছিল তার এই তত্ত্ব। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লুথার লিখেছিলেন ‘Ninety Five Thisis’। তার উদ্দেশ্য ছিল রােমান ক্যাথেলিক যাজকদের সঙ্গে প্রকৃত ধর্মের চরিত্র কি সেই বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়া। ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দে লিয়জিগ-এ গশীল ধর্মযাজকদের সঙ্গে বিতর্কে নেমে তিনি পােপতন্ত্র সম্পর্কে নানা প্রশ্ন তােলেন। পােপতন্ত্র ঈশ্বরের সৃষ্টি’—এই মত তিনি খণ্ডন করেন। ১৫২০ খ্রীষ্টাব্দে Babylonish captinity of the charch পুস্তিকায় পুরােহিততন্ত্রের অবসানের দাবি তােলেন। তার ধর্মতত্ত্বের মধ্যযুগীয় চার্চের সাংগঠনিক কাঠামােকে আঘাত করার পাশাপাশি রাষ্ট্র ও চার্চের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন এক পরিবর্তনের সূচনা করেন। রাষ্ট্রবাদী যাজকতন্ত্রের সমর্থনে লুথার বলেন যে একটি দুর্নীতিগ্রস্ত ধর্মীয় সংগঠনকে নিয়ন্ত্রণের অধিকার রাজার আছে। কারণ আঞ্চলিক রাজশক্তির সহায়তা ছাড়া চার্চকে নতুন রূপে সংগঠিত করা সম্ভব ছিল না। একই বছরে তিনি ‘Appel to christan Nobility of the Jarman Nation’ শীর্ষ পুস্তিকায়। রােমান ক্যাথেলিক চার্চের বিরােধে জার্মানীর রাজন্যবর্গকে সংঘবদ্ধ হতে আহ্বান জানান। লুথার উপলব্ধি করেন যে পােপ নামক ক্ষমতালােভী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা প্রয়ােজন। এই বছর ডিসেম্বরে পােপের বহু অনুশাসন জনসমক্ষে ভস্মিভূত করেন। উত্তর ইউরােপের বণিক ও কৃষিজীবী শ্রেণির মানুষ লুথারের মতবাদ দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন এবং ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন তীব্রতর হয়।
আন্দোলনের প্রসার :- জার্মানীতে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল জার্মান সংলগ্ন জার্মান ভাষাভাষী অঞলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সুইজারল্যান্ড ও অস্ট্রিয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রসারিত হয় পশ্চিম ও দক্ষিণ-ইউরােপে। অবশ্য স্থানভেদে আন্দোলনের গতি ও সাফল্যের তারতম্য ছিল। এই সাফল্য অনেকটা নির্ভরশীল ছিল সংস্কারকামী যাজকদের সাথে আঞ্চলিক রাজশক্তি সম্পর্কের উপর। জার্মানীতে ধর্ম-সংস্কার আন্দোলন ঘটেছিল দ্রুততার সাথে, কিন্তু ইংল্যাণ্ড, সুইডেন, নরওয়ে প্রভৃতি দেশে প্রাথমিক পর্বে সংস্কার আন্দোলনের গতি ছিল শ্লথ। অবশ্য পরে রাজশক্তির আনুকূল্যেও এইসব দেশেও সংস্কার আন্দোলন সফল হয়েছিল। মার্টিন লুথার ক্ষুব্দ কৃষকশ্রেণী ও রাজন্যবর্গের সমর্থনে যে দ্রুততার সাথে সাফল্য পেয়েছিলেন অন্যান্যদের ক্ষেত্রে তার গতি ছিল শ্লথ। প্রাথমিক বাবে রাজা পঞ্চম চার্লস Adict of worms দ্বারা লুথারকে আইন বহির্ভূত ঘােষণা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজ্যবর্গের আনুকল্যে লুথার প্রতিবাদী সংগ্রাম গড়ে তােলেন। এইভাবে জার্মানীতে তথা ইউরােপে ধর্মশ্রেণিক বিভাজন সৃষ্টি হয়। একদিকে ছিলেন প্রতিবাদী। মতের অনুগামী রাজনবর্গ এবং অন্যদিকে ক্যাথেলিক ধর্মের ধারক রােমান পােপ ও পবিত্র রােমান সাম্রাজ্য। মার্টিন লুথার পােপ ও সম্রাটের বহুজাতিক রাজনৈতিক আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে আলিক রাজশক্তিকে সংগঠিত করেছিলেন। তার ফলে প্রতিবাদী ধর্মমত জাতীয় রাজতন্ত্রের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .