ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান
নারীশিক্ষা বিস্তার ও ভারতবর্ষে নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত ছিলেন বিদ্যাসাগর। সমাজের অর্ধেক অংশ নারীকে বাদ দিয়ে সমাজের উন্নতি করা যায়। —এই ছিল তার ধারণা। তাই কেবল ছেলেদের শিক্ষাই নয় মেয়েদের শিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগরের চেষ্টা ছিল প্রবল। এই চেষ্টার ফলশ্রুতি হল-
(১) বেথুন বিদ্যালয়
১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন সাহেব যখন শিক্ষাপরিষদের সভাপতি ছিলেন তখন থেকেই বিদ্যাসাগর তার সহকর্মী হিসাবে কাজ করেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে বেথুন সাহেব কয়েকজন বাঙালি নেতাদের সাহায্যে মেয়েদের শিক্ষার জন্য অবৈতনিক স্কুল স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে তা বেথুন স্কুল নামে পরিচিত। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যাসাগর এই স্কুলের দায়িত্ব নেন। এই বিদ্যালয়ের দায়িত্ব পেয়ে তিনি বন্ধুবান্ধব ও পরিচিত ভদ্রলােকদের বেথুন স্কুলে নিজ নিজ কন্যাদের পড়াবার জন্য পাঠাতে অনুরােধ করেন। তার অনুরােধের ফলে পণ্ডিত তারানাথ বাচস্পতি, শম্ভুনাথ পণ্ডিত, হরদেব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ অভিজাত ব্যক্তিগণের কন্যারা এখানে ভরতি হয়। বেথুন স্কুল পরিচালনায় যােগ্যতা ও কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
(২) বেথুন স্কুলের পুনর্গঠন
এই স্কুলের পুনর্গঠন সম্পর্কে বিদ্যাসাগর ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ২৪ ডিসেম্বরের সংবাদ প্রভাকরে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন, তাতে উল্লেখ ছিল যে হিন্দু জাতিয় স্ত্রী লােকেদের যথােপযােগী শিক্ষা হলে হিন্দু এবং তদদেশের কত উপকার হবে তা এ বিষয়ে সার্বিক উল্লেখ করা অত্যাবশ্যক। স্ত্রীরা শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন হলে শিশু সন্তানগণকে শিক্ষা দিতে পারবেন। স্ত্রী ও কন্যাগণের মনােবৃত্তি প্রকৃতরূপে মার্জিত হলে সকল কার্যের অনুষ্ঠান সুচারুরূপে সম্পাদিত হবে।
(৩) বাংলার পল্লি অঞ্চলে নারীশিক্ষার বিস্তার
বিদ্যাসাগর শুধু বাংলা তথা ভারতের মধ্যকেন্দ্র কলকাতার নারীশিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিলেন তা নয়। বাংলার পল্লি অঞ্চলে নারীশিক্ষার ক্ষেত্র প্রস্তুত ও বিস্তার করেছিলেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজে জৌন গ্রামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
(৪) নারীশিক্ষার ভাণ্ডার গঠন
বিদ্যাসাগর আশা করেছিলেন যে, বিদ্যালয়গুলি ভারত সরকারের আর্থিক সহায়তা পাবে, কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভারত সরকার আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে অনিচ্ছুক। এই নিয়ে বিদ্যাসাগর অনেক লেখালেখি করলেন যাতে একবারের মতাে টাকা মঞ্জুর হয়। এরপর ভারত সরকার জানিয়েছিল যে—বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়গুলির জন্য কোনাে স্থায়ী অর্থসাহায্য দিতে পারবে না। তখন বিদ্যাসাগর বিদ্যালয়গুলির আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য নিজেই জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থসাহায্য নিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়গুলি চালানাের চেষ্টা করেন। একেই বলা হয় নারীশিক্ষা
(৫) বিভিন্ন জেলায় বালিকা বিদ্যালয় সংখ্যা
হ্যালিডের সঙ্গে একমত হয়ে বিদ্যাসাগর স্থির করেন, যে গ্রামের অধিবাসীরা বিদ্যালয়ের জন্য স্থান দিতে পারবেন, সেই গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলায় ৩টি, বর্ধমান জেলায় ৪টি, হুগলি জেলায় ২০টি, নদিয়া জেলায় ১১টি, মােট ৩৫টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। মােট ছাত্রীসংখ্যা ছিল ৩৫০০।
(৬) মেয়েদের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপন
স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারে বিদ্যাসাগরের উৎসাহ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে শিক্ষিকা গড়ে তুলবার জন্য বেথুন স্কুলে একটি নর্মাল স্কুল খােলার জন্য মিস্টার কার্পেনটালের সহায়তায় এক আলােচনা শুরু হয় এবং মেয়েদের জন্য নর্মাল স্কুল স্থাপন করা হয়। নর্ম্যাল স্কুল স্থাপনে বিদ্যাসাগরের অবদান অনস্বীকার্য।
সুতরাং উপরােক্ত আলােচনা থেকে বলা যায়, সমাজসংস্কারক হিসাবে বিধবাবিবাহ আইন পাশ, বহুবিবাহ রােধ, বাল্যবিবাহ বিরােধিতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের যা মুক্তি ঘটিয়েছিলেন, তেমনি তিনি নারীশিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন জেলায় মেয়েদের বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, গঠন করেছেন নারীশিক্ষা ভাণ্ডার। তাই তাকে বলা যায় নারীশিক্ষা প্রসারের অগ্রদূত।
Read More
- ব্রহ্মবাদিনী ও সদ্যোবাদ বলা হত?
- স্ত্রীধন বলতে কী বােঝ?
- কন্ঠী ও কল্পী কী?
- শক্তিনী কাদের বলা হত?
- মিস মেরি কার্পেন্টর কে ছিলেন?
- উডের ডেসপ্যাচ কেন গুরুত্বপূর্ণ?
- পণ্ডিতা রামাবাঈ কে?
- বেগম রােকেয়া শাখাওয়াত কে ছিলেন?
- মাতাজী মহারানি তপস্বিনী কে ছিলেন?
- ভগিনী সুব্বালক্ষ্মী কে ছিলেন?
- সারদা সদন কে, কী উদ্দেশ্য স্থাপন করেন?
- নারীশিক্ষার বিভিন্ন সমস্যাগুলি ব্যাখ্যা করাে।
- নারী শিক্ষার সমস্যা সমাধানের উপায়গুলি কী কী ?
- নারীশিক্ষায় বিবেকানন্দের অবদান উল্লেখ করাে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .