হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের সামাজিক জীবন
শ্রেণিবিভক্ত সমাজ
শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অস্তিত্ব হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দুর্গ অঞ্চলেই ছিল শাসকদের বাসগৃহ। শহরের দ্বিতল-ত্রিতল গৃহগুলিতে বাস করত ধনী ও মধ্যবিত্ত বণিক সম্প্রদায় এবং খুপরি জাতীয় ঘরগুলি ছিল শ্রমজীবী দরিদ্রদের বাসস্থান। এই শহরগুলিতে ক্রীতদাসরাও ছিল। তারা দীনহীন কুটিরে বাস করত এবং ফসল মাড়াই, ভারী বােঝা বহন, শহরের জঞ্জাল পরিষ্কার প্রভৃতি কাজ করত।
খাদ্য
এই সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও তার মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। এখানকার অধিবাসীরা গম, যব, বার্লি, ভাত, ফলমূল, তিল, মটর, রাই, খেজুর, বাদাম, শাক-সবজি ও মুরগি, ভেড়া, গােরু ও বিভিন্ন পাখির মাংস, দুধ খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করত। মাছ এবং ডিম তাদের খাদ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
পশু-পাখি
বিভিন্ন পশুর কঙ্কাল, শিশুদের খেলনা এবং বিভিন্ন সিলে অঙ্কিত চিত্র থেকে হরপ্পার পশু-পাখি সম্পর্কে ধারণা করা যায়। গৃহপালিত জন্তুর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল গােরু, মহিষ, ভেড়া, উট, হাতি, শূকর ও ছাগল। এছাড়া বাঘ, বাইসন, গণ্ডার, ভল্লুক, খরগােশ তাদের অজানা ছিল না।
পােশাক-পরিচ্ছদ ও অলংকার
সিন্ধুবাসীরা সুতি ও পশমের বস্ত্র ব্যবহার করত। মেয়েরা সােনা ও রুপার ফিতে দিয়ে নানা ধরনের খোপা করত। তারা নানা ধরনের প্রসাধন সামগ্রী, সুগন্ধি এবং তামা, ব্রোঞ্জ, সােনা, রুপা ও পাথরের তৈরি নানা ধরনের ও নানা আকারের হার, কানের দুল, চুড়ি, আংটি, মল, কোমরবন্ধ ও মালা ব্যবহার করত। সুরমার ব্যবহার তাদের অজানা ছিল না।
গৃহস্থালির সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র এবং আমােদ-প্রমােদ
হরপ্পার গর্ভে পাথর, মাটি, তামা, সিসা, ব্রোঞ্জ ও কাঠের তৈরি বাসনপত্র ও গৃহস্থালির নানা সরঞ্জাম আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলির মধ্যে বাটি, জগ, মাদুর, খাট, চেয়ার, টুল, আয়না, চিরুনি, কাচি, সূচ, ক্ষুর প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক জীবন
কৃষি
হরপ্পা সভ্যতার আর্থিক সমৃদ্ধি বহুলাংশে তার সন্নিহিত গ্রামীণ অঞ্চলের উন্নত কৃষি-অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল ছিল। প্রচুর বৃষ্টিপাত এবং সিন্ধু ও তার শাখানদীর বন্যায় এই অঞ্চল যথেষ্ট উর্বর ছিল। ফসল উৎপাদনের জন্য সার, জলসেচ বা দক্ষতার বিশেষ প্রয়ােজন হতাে না। রবিশস্য হিসেবে গম ও যবের চাষ হতাে। খারিফ শস্য হিসাবে তুলাে, তিল উৎপন্ন হতাে।
শিল্প
হরপ্পা সভ্যতায় শিল্পগুলির মদ্যে বয়নশিল্প, প্রস্তরশিল্প, ধাতুশিল্প, মৃৎশিল্প, গজদন্তশিল্প, কাঠের কাজ, চিনামাটির কাজ, ইটশিল্প, অলঙ্কার শিল্প, চুনাপাথরের কাজ বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল। বস্ত্রবয়ন ছিল হরপ্পা সভ্যতার একটি প্রধান শিল্প। এই অঞ্চল থেকে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সুতিবস্ত্র রপ্তানি করা হতাে। প্রস্তর শিল্পেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়। ধাতুশিল্পীরা তামা, ব্রোঞ্জের নানা দ্রব্যাদি যথা কাস্তে, কুঠার, প্রদীপ, কলসি, ছুরি, বাসন, মূর্তি প্রভৃতি তৈরি করত। সােনা ও রুপার অলংকার নির্মাণেও শিল্পীরা দক্ষ ছিল। মৃৎশিল্পের ক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত।
ব্যাবসা-বাণিজ্য
ভারত ও ভারতের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে হরপ্পার বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। বাণিজ্যের জন্য জলপথ ও স্থলপথ – দুই-ই ব্যবহৃত হতাে। শিল্পের প্রয়ােজনে বিভিন্ন স্থান থেকে কাচামাল আমদানি করা হতাে। হিমালয় থেকে দেবদারু কাঠ, কর্ণাটক থেকে সােনা, রাজপুতানা থেকে তামা ও সিসা, দক্ষিণ ভারত থেকে সিসা, রাজপুতানা-গুজরাট থেকে দামি পাথর, কাথিয়াওয়াড় থেকে শাখ আসত। ভারতের বাইরে বেলুচিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান থেকে আমদানি করা হতাে সােনা, রুপা, সিসা, টিন ও দামি পাথর। সিন্ধু উপত্যকা থেকে রপ্তানি করা হতাে তুলাে, সুতিবস্ত্র, তামা, হাতির দাঁত ও হাতির দাঁতের তৈরি নানা জিনিসপত্র। সুতিবস্ত্র ও তুলাে ছিল রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ।
যানবাহন ও সামুদ্রিক যােগাযােগ
স্যার মার্টিমার হুইলার মনে করেন যে সিন্ধুবাসীরা পরিবহণের মাধ্যম হিসেবে উট, গাধা ও ঘােড়া ব্যবহার করত। ঘােড়ার ব্যবহারও ছিল খুব সীমিত। সিন্ধুবাসী দু’চাকা বিশিষ্ট ঠেলাগাড়ি এবং গরু, ষাঁড় ও গাধায় টানা গাড়ি ব্যবহার করত।
ওজন ও মাপ
ওজন ও মাপের ব্যাপারেও সিন্ধুবাসী যথেষ্ট দক্ষ ছিল। এখানে নানা ওজনের বিভিন্ন বাটখারা, ব্রোঞ্জনির্মিত কয়েকটি দাঁড়িপাল্লা এবং ধাতুনির্মিত গজকাঠি পাওয়া গেছে। সমগ্র এলাকায় একই ধরনের ওজন ও মাপ প্রচলিত ছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .