ভৌগােলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ যে-কোনাে দেশের মানুষ ও ইতিহাসকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। আরবের মরুভূমি যেমন আরববাসীকে কষ্ট সহিষ্ণু করেছে, তেমনি তাদের আচার আচরণ, শিল্প সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক জীবনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। আবার জাপানের দ্বীপময় প্রাকৃতিক পরিবেশ সেখানকার জনসাধারণের ওপর প্রাকৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছে। ঐতিহাসিক রিচার্ড হ্যাকলিউট বলেছেন- “Geography and Chronology are left eye of all history.”
হিমালয়ের প্রভাব
ভারতের ইতিহাসে হিমালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রথমত, হিমালয় উত্তর ও মধ্য এশিয়ার প্রচণ্ড শীতল বায়ুকে রােধ করে ভারতকে শৈত্য প্রবাহের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু হিমালয়ে বাধা পেয়ে ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়, যা ভারতকে শস্য শ্যামলা যেমন করে তুলেছে তেমনি জলবায়ুকে রেখেছে নাতিশীতােষ্ণ।
তৃতীয়ত, হিমালয় মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ যাযাবার জাতিগুলিকে আক্রমণে বাধা দিয়ে ভারতীয় সভ্যতাকে স্থিতিশীল করে তুলেছে।
চতুর্থত, হিমালয় পর্বতের গিরিখাতগুলি আর্য, শক, পস্থর প্রভৃতি জাতিগুলিকে ভারতে প্রবেশ করতে সাহায্য করে যা ভারতীয় সভ্যতাকে উন্নত করেছে।
পঞ্চমত, বােলান, খাইবার, গােমাল প্রভৃতি। গিরিখাতগুলি ব্যাবসাবাণিজ্যের পথরূপে ব্যবহৃত হয়ে ভারতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে তােলে।
ষষ্ঠত, হিমালয়ের তুষারগলাজলে ভারতীয় নদীগুলি সৃষ্টি হওয়ায় শস্য উৎপাদন ও অভ্যন্তরীণ ব্যাবসাবাণিজ্যের ধারাকে গতিশীল করেছে। এই সমস্ত কারণগুলির জন্য ড. কে, এম, পানির তীর ‘A survery of Indian History’ গ্রন্থে ভারতকে ‘হিমালয়ের দান’ রূপে উল্লেখ করেছেন।
বিন্ধ্যপর্বতের প্রভাব
বিন্ধ্য পর্বতমালা ভারতকে দু-ভাগে ভাগ করেছে—উত্তরাপথ বা আর্যাবর্ত এবং দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্য। দীর্ঘদিন এই পর্বতমালা উত্তরাপথের আর্যসংস্কৃতিকে দাক্ষিণাত্যের অনুপ্রবেশে বাধা প্রদান করেছে। ফলে দাক্ষিণাত্যে দীর্ঘকাল দ্রাবিড় সভ্যতা। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। দাক্ষিণাত্যের ভৌগােলিক অবস্থান ও ভূপ্রকৃতির সাহায্য নিয়ে শিবাজি মােগলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মারাঠা সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখেন। ভৌগােলিক কারণে উত্তর ভারতের মতাে দাক্ষিণাত্যে বার বার বৈদেশিক আক্রমণ ঘটেনি। ফলে এখানে হিন্দু মন্দির, শিল্পকলা ও স্থাপত্য অনেক নিরাপদ ছিল। ফলে দাক্ষিণাত্যের জীবন যাত্রা ছিল অনেক স্থিতিশীল। এই স্থিতিশীলতা ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রসারে সাহায্য করেছিল।
সমুদ্রের প্রভাব
পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণদিকব্যাপী সাগর উপসাগরগুলি প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের ইতিহাস ও জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। ভারতের নিরাপত্তা সমুদ্রের দ্বারা অনেকখানি সুনিশ্চিত হয়েছে। সুদূর অতীতকাল থেকে ভারতের সঙ্গে চিন, আরব, রােম, সিংহল, জাভা, সুমাত্রা অঞ্চলের যােগাযােগ সাধনে সমুদ্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এর ফলে ভারতে বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি যেমন ঘটে তেমনই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ইউরােপীয় জাতির কাছে প্রথম ভারতের দরজা খুলে দেন ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কো-ডা-গামা। এর পর ফরাসি ও ইংরেজ জাতি ভারতবর্ষে এসে এখানে ঔপনিবেশ গড়ে তােলে। অন্যদিকে এই জাতিগুলির সংস্পর্শে ভারতের আধুনিক যুগের সূচনা হয়।
নদ-নদীর প্রভাব
ভারতের ইতিহাসে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদ-নদী না থাকলে, হয়তাে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশই সম্ভব হত না। এগুলি শুধু যােগাযােগ ব্যবস্থাই গড়ে তােলেনি, বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চলকে বিধৌত করে ভারতকে শস্যশ্যামলা করে তুলেছে। নদ-নদীগুলিই ভারতীয় প্রাচীন সভ্যতারূপে হরপ্পা সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিল; আবার সিন্ধুনদের গতি পরিবর্তন এই সভ্যতার ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তী বৈদিক যুগের শেষদিক থেকে নদীগুলিই মহাজনপদ গড়ে তুলতে সাহায্য করে এবং পরবর্তী সময়ে পাটলিপুত্র, কনৌজ, দিল্লি, আগ্রা এলাহাবাদ প্রভৃতি বর্ধিষ্ণু নগরগুলি গড়ে উঠতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, নদ-নদীগুলিকে ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রধান মাধ্যম রূপে ব্যবহার করে ভারতের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল। পাশাপাশি কৃষি, ধর্ম ও সংস্কৃতির বিকাশেও নদীগুলি বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। এক কথায় বলা যায় ভারতের নদ নদীগুলি ভারতীয় সভ্যতা ও জনজীবনের ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .