বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক কীভাবে ঋণ সৃষ্টি করে
ঋণ সৃষ্টি করা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে গণ্য করা হয়। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির কাছে যে পরিমাণ নগদ অর্থ আমানত হিসাবে জমা পড়ে, তা থেকেই ব্যাঙ্ক ঋণ দিয়ে থাকে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের ঋণ সৃষ্টি বলতে ঋণ ও অগ্রিম মারফত আমানত বৃদ্ধি করার ক্ষমতাকেই বোঝায়। প্রতিদিন কেউ ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেয়, আবার কেউ ধার নেয়। এই চলতি আমানতকে উদ্ভূত আমানত বা সৃষ্ট আমানত বা ঋণ আমানত বা সক্রিয় আমানত বলে।
উদ্ভূত আমানত থেকেই বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি ঋণ বা আমানত সৃষ্টি করে। তাই বলা হয় – “Every loan creates a deposit” অর্থাৎ প্রতিটি ঋণই আমানত সৃষ্টি করে।
প্রধানত দু’টি উপায়ে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি আমানত সৃষ্টি করে –
1. কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন তার নিজ উদ্যোগে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা দেয়, তখন ব্যাঙ্ক সেই ব্যক্তির নামে ব্যাঙ্কের খাতায় যে হিসাবটি রাখে, তাকে বলা হয় প্রাথমিক আমানত (Primary Deposit)। এক্ষেত্রে জনসাধারণের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ কমে আসে এবং ব্যাঙ্ক আমানতের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। তার ফলে দেশের মোট অর্থের জোগান একই থাকে। তাই এই ধরনের লেনদেনকে ‘নিষ্ক্রিয় লেনদেন’ বলে।
2. বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক কোনো ব্যক্তি বা সংস্থাকে কোনো মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখার বিনিময়ে ঋণগ্রহীতাকে ঋণ দিয়েও থাকে। ব্যাঙ্ক ঋণের টাকা সরাসরি ব্যক্তির হাতে না দিয়ে ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে জমা করে দেয়। এক্ষেত্রে অর্থনীতিতে নগদ অর্থের জোগান বৃদ্ধি পায় বলে একে সক্রিয় লেনদেন (Active transaction) বলে। এভাবে যে আমানত সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় উদ্ভূত আমানত (Devivative Deposit)। ঋণ গ্রহণকারীর অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে কোনো ব্যাঙ্কে চলতি আমানত হিসাবে জমা পড়ে। পুনরায় ব্যাঙ্কের চলতি আমানত বাড়ে এবং বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যৌথভাবে গুণক প্রক্রিয়ায় আমানতের মাধ্যমে ঋণ বা অর্থ সৃষ্টি করে।
ধরা যাক, কোনো ব্যক্তি এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে ১০০০ টাকা জমা দিয়ে আমানতি অ্যাকাউন্ট খুললেন। এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক যদি ১০ শতাংশ নগদে সংরক্ষিত রেখে বাকি ৯০ শতাংশ ঋণ দেয় তাহলে এক্ষেত্রে ১০০০ টাকার ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ৯০০ টাকা ব্যাঙ্ক অপর কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দিতে পারে। ধরা যাক, এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক ওই ৯০০ টাকা ‘অগ্নি পেন কোম্পানি’কে ঋণ দিল। ‘অগ্নিপেন কোম্পানি’ ওই ৯০০ টাকা পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে প্রাথমিক আমানত হিসাবে জমা দিল। পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এই টাকার ১০ শতাংশ রিজার্ভ রেখে ৮১০ টাকা অপর কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দিল। ওই ব্যক্তি ওই ৮১০ টাকা ‘দেনা ব্যাঙ্কে’ প্রাথমিক আমানত হিসাবে জমা দিল। দেনা ব্যাঙ্ক ওই ৮১০ টাকার ১০ শতাংশ নগদে জমা রেখে বাকি ৭২৯ টাকা অপর কোনো ব্যক্তিকে ঋণ দিল। সেই ঋণ আবার একইভাবে ব্যাঙ্কে জমা পড়ল। এই প্রক্রিয়া একইভাবে চলতে থাকলে অবশেষে দেখা যাবে যে মোট (৯০০ টাকা + ৮১০ টাকা + ৭২৯ টাকা + ……) ৯০০০ টাকার ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে মূল আমানত ১০০০ টাকা যোগ করা হলে মোট আমানতের পরিমাণ হবে ১০,০০০ টাকা। অর্থাৎ দেখা গেল যে, ১০০০ টাকার মূল আমানত থেকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি সম্মিলিতভাবে ১০ গুণের মতো আমানত সৃষ্টি করতে পারে।
মন্তব্য
উপরের আলোচনা থেকে দেখা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি আমানত সৃষ্টির মাধ্যমে গুণক প্রক্রিয়ায় অনেক গুণ ঋণ সৃষ্টি করে। অধ্যাপক সেয়ার্স যথার্থই বলেছেন : “Banks are not merely purveyours of money, but also in an important sense, manufactures of money”
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .