নব্যবঙ্গ আন্দোলন ও তাৎপর্য
পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভারতীয় জনমানসে যে নবচেতনার জাগরণ ঘটেছিল তা নব জাগরণ’ বলে খ্যাত। কিন্তু তারসম্পর্কে মুসলমান সম্প্রদায় প্রায় উদ্যমহীন। সে ক্ষেত্রে নবজাগরণের প্রভাব পড়ে বাংলার হিন্দু সমাজের মধ্যেই। তাই বাংলার নবজাগরণ হিন্দু নবজাগরণ নামেই অধিক পরিচিত। ঊনবিংশ শতকের এই নবজাগরণের প্রভাব সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয় বাংলার তথাকথিত বধিষু মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মধ্যে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চ জাত বাঙালী হিন্দু পরিবারের সন্তানেরা স্বদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির উগ্র সমালােচক হয়ে ওঠেন। এঁরা সকলেই ঐতিহ্যগত সামাজিক কুসংস্কার ও ত্রুটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ক্রমশ সােচ্চার হন। এঁরা হয়ে ওঠেন সমাজ সংস্কারকদের গােষ্ঠীভূক্ত। যুক্তিবাদ এদের প্ররােচিত করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত কু-অভ্যাস, ব্যাভিচার, দুর্নীতিগুলিকে আক্রমণ করে প্রগতিমূলক বাতাবরণ সৃষ্টি করতে। আধুনিক যুক্তিবাদী চিন্তাধারার অন্তর্গত সংস্কারবাদীরা – যাঁরা প্রাচ্য ঐতিহ্যকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করতে সচেষ্ট হন। তারাই নবজাগরণের ইতিহাসে নব্যবঙ্গীয় আন্দোলনকারী হিসাবে পরিচিত হন। ইংরেজ জাতির সমাজ ও সভ্যতার আলােকে এঁরা এমনভাবে অভিভূত হয়ে পড়েন যে ইংরেজদের আদব-কায়দা, আচার-আচরণ সবকিছুই অনুকরণযােগ্য বলে মনে করেন। এঁরাশূকর মাংস ও গােমাংস ভক্ষণ, মদ্যপান ইত্যাদি অভ্যাস গ্রহণ করেন এবং রক্ষণশীল ব্যক্তিবর্গকে অক্লেশে গালিগালাজ করে গর্ব অনুভব করেন। যেন রক্ষণশীলতাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে পারলেই পাশ্চাত্য শিক্ষার মূর্ত প্রতীক হওয়া সম্ভব হবে।
ভারতের তথা বাংলার সমাজ জীবনে ইংরাজী শিক্ষার ধ্বজাধারী এই গােষ্ঠীর সদস্যরা বেশিরভাগই ছিলেন পাশ্চাত্য-শিক্ষা পরিবেশনের মূলকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হিন্দু কলেজের ছাত্র। এই হিন্দু কলেজে রিচার্ডসন, ডিরােজিও এবং অন্যান্য প্রতিভাবান শিক্ষকেরা তাদের ছাত্রদের হিন্দু সমাজের কুসংস্কার, সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি প্রভৃতি থেকে দূরে থাকতে পরামর্শ দেন। এসব শিক্ষক ছাত্রদের আদর্শ যুক্তিবাদী শিক্ষাদান করার সঙ্গে সঙ্গে পরাধীন দেশ মাতার মুক্তি সাধনা করতেও পরামর্শ দেন।
এই শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম উদ্দীপ্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরােজিও। তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক। ডিরােজিও ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার এক পর্তুগীজ বংশােদ্ভূত ইঙ্গ-ইউরােপীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী।তার জ্ঞানস্পৃহা ছিল অদ্বিতীয়। তিনি সুলেখক, কবি ও দার্শনিক হিসাবেও প্রসিদ্ধ লাভ করেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ডিরােজিও হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার কাজ শুরু করেন। ১৮২৬ থেকে ১৮৩১ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত থাকেন। হিন্দু কলেজের পরিচালকমন্ডলীর সাথে মতবিরােধের জন্য তিনি ১৮৩১ খ্রিঃ চাকরিতে ইস্তফা দেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ মনে করেন। যে ডিরােজিও ছাত্র-সম্প্রদায়কে বিপথে চালিত করছিলেন। ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে মাত্র ২৩ বছর বয়সে এই প্রলয়শিখা-স্বরূপ শিক্ষক বসন্তরােগে মৃত্যু বরণ করেন।
ফিরিঙ্গি অধ্যাপক হিন্দু কলেজের ছাত্র সমাজের কাছে ছিলেন এক মহা আকর্ষণের মানুষ। তিনি প্রায় সর্বক্ষণই ছাত্র পরিবেষ্টিত থাকতেন। তাঁর আন্তরিকতার দরুন ছাত্রসমাজ মনে করে ডিরােজিও ছাড়া কেউই তাদের সত্যের পথে চলার প্রেরণা জোগান দিতে পারবেন না। তাই ছাত্ররা তার বক্তব্যকেই সর্বদা শিরােধার্য বলে মনে করত। ডিরােজিওর ধ্যান ধারণাই তাদের ধ্যান ধারণা বলে তারা মনে করত। জাতিভেদ, কুন্সংস্কার, পৌত্তলিকতা প্রভৃতি সম্পর্কে ডিরােজিও ছাত্রদের সঙ্গে আলােচনা করতেন, ছাত্ররাও এগুলি সম্পর্কে নিজেদের নির্ভীক স্বাধীন চিন্তাধারা গঠন করতে সক্ষম হতেন। এরাই ‘নব্যবঙ্গ’ নামে অভিহিত হন। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য যারা ছিলেন তারা হলেন রাধানাথ সিকদার, রসিককৃয় মল্লিক, রামতনু লাহিড়ি, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিত্ব। তাঁরা ‘ডিরােজিওপন্থী বলেও পরিচিত হন।
আধুনিক বাঙলী জীবনের নব্যবঙ্গীয়দের অবদান
ডিরােজিওপন্থীরা ব্যাপক প্রচারকার্য চালিয়ে সুচিন্তিত যুক্তিবাদী চিন্তাধারা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতেন – বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নের ব্যাপারে জনমত সুগঠিত করে তুলতে চেষ্টা করতেন। এই প্রচারমুখী কার্যসূচি নির্ণয় করার জন্য ১৮২৮ খ্রীঃ ‘একাডেমিক অ্যাসােসিয়েশান’ নামে এক নব্যবঙ্গীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা একটা সংবাদপত্রের প্রকাশনাও করেন—“বেঙ্গল স্পেক্টোটর”-এর মাধ্যমে নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে তুলে ধরা হত। ১৮৩৮ খ্রীঃ ‘সােসাইটি ফর দি অ্যাকুজিশন অব জেনারেল নলেজ’ নামে আরও একটি সংস্থা স্থাপিত হয় মূলত রাজনৈতিক আলােচনার কেন্দ্র হিসাবে। ডিরােজিওপন্থীরা বিদেশে ভারতীয় শ্রমিকদের দূরবস্থা, বিচার-ব্যবস্থায় জুরি নিয়ােগ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
প্রাচীনপন্থীদের মতে এই “ফিরিঙ্গি’দল তৎকালীন হিন্দুধর্ম ও সমাজকে বিপদের মধ্যে ফেলেছিলেন। যা হােক, এ কথা অস্বীকার করার সুযােগ নেই যে ডিরােজিওপন্থীদের হাতেই ভারতের রক্ষণশীলতার দূর্গ ভেঙে পড়েছিল। মাঝেমধ্যে তাদের উগ্র পাশ্চাত্যপ্রেমী অভ্যাসগুলি অশালীন হলেও সমাজকে কলুষমুক্ত করার ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা ছিল মহান ও সৎ। সমাজ সংস্কার, গণতন্ত্র, চিন্তাধারার মুক্তি, পাশ্চাত্য শিক্ষার মূল্য উপলব্ধি প্রভৃতি বিষয়ে তারা বাস্তবিকভাবেই প্রগতির পরিচয় দিয়েছিলেন। অন্যদিকে একথাও ঠিক যে, ডিরেজিওপন্থীরা তাদের অন্ধ ভক্তির জন্য পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে মিশ্রিত পাশ্চাত্যের নগ্ন ও ধ্বংসাত্মক দিকগুলিকে তারা নিন্দা করেননি। তাছাড়া, তারা তাদের মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রকে বিস্তারে আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে। কলকাতার পরিবেশ ছেড়ে ডিরােজিওপন্থীরা বাংলার গ্রামাঞলে প্রবেশ না করে সংকীর্ণতার পরিচয় রেখেছিলেন। তাই বৃহত্তর পরিধির অভাবে ডিরােজিওর সৈনিক ছাত্ররা প্রকৃত অর্থে জাতীয় জাগরণের অংশীদার হতে পারেননি।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .