মধ্যযুগের ইউরােপে আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রধানত ছিল সামন্ততন্ত্র। সামন্ততন্ত্র বলতে বােঝায় জমিকেন্দ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নতুন ধরনের আর্থ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যবস্থা। পশ্চিম ইউরােপে সামন্ততন্ত্রের সময়কাল ছিল মােটামুটি নবম-দশম থেকে পঞ্চদশ শতক।।
সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব
সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে রয়েছে বিতর্ক।
ইউরােপীয় বাণিজ্যের সংকোচন
বেলজিয়ান ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন-এর মতে, অষ্টম শতাব্দীতে গড়ে ওঠা সামন্ততন্ত্র ছিল ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যনির্ভর অর্থনীতিতে আরবীয় ইসলামের রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের ফলশ্রুতি।
বাণিজ্যিক কাঠামােয় বিপর্যয়
জার্মান ঐতিহাসিক আলফন্স উপশ-এর মতে, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আরব আধিপত্য স্থাপনের পাশাপাশি নবম শতকের দ্বিতীয় ভাগে পশ্চিমে ম্যাগিয়ার ও উত্তরদিকে ভাইকিংদের বারংবার আক্রমণে ইউরােপের বাণিজ্যিক কাঠামাে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এই আক্রমণ প্রতিরােধে ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে ভূমিকেন্দ্রিক অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।
ক্যারােলিীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা
ঐতিহাসিক মার্সে ব্লখের মতে, অর্থনীতি অপেক্ষা বিশেষ একটি রাজনৈতিক ঘটনা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের ক্ষেত্রে অধিক ক্রিয়াশীল ছিল। ভার্দুনের চুক্তি (৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে)-তে ক্যারেলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যকে তিনভাগে ভাগ করা হলে শার্লাম্যান প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ইউরােপে ম্যাগিয়ার, ভাইকিং আক্রমণকে ভগ্নপ্রায় ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্য প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়। পক্ষান্তরে, পশ্চিম ইউরােপে জনগণের জীবন ও সম্পত্তিকে রক্ষা করতে তৎকালীন আঞ্চলিক সামরিক নেতৃবর্গ ও ভূম্যধিকারী সম্প্রদায় এগিয়ে আসে। এভাবেই আঞ্চলিক রক্ষাকর্তারা সামন্তপ্রভুতে পরিণত হয়।
ম্যানর ব্যবস্থা
সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের সঙ্গে অপর একটি বিষয় জড়িত ছিল যা ম্যানর ব্যবস্থা নামে পরিচিত। ভূম্যধিকারী প্রভুর বসতবাটি সহ বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র (Estate of land) ম্যানর নামে পরিচিত ছিল। ম্যানর প্রভুর ভূমিদাস বা অধীনস্ত প্রজারা এখানে চাষবাস করত এবং উৎপন্ন খাদ্যশস্য সহ ফসলের উদ্বৃত্ত প্রভুর হাতে তুলে দিত।
উপসংহার
উপরােক্ত আলােচনা থেকে দেখা যায় যে,ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যের ওপর আরব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, ভাইকিং-ম্যাগিয়ারদের আক্রমণ, ভার্দুন চুক্তি ও ক্যারােলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের দুর্বলতা এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তে অঞ্চলগত ব্যক্তি নিয়ন্ত্রণাধীন শাসন, বিচার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভবের ফলশ্রুতি ছিল সামন্ততন্ত্র। সামন্ততন্ত্রের একটি ক্রমােচ্চ স্তরবিন্যস্ত রাজনৈতিক বিন্যাস ছিল এবং সর্বোচ্চে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন রাজা, রাজার নীচে ছিলেন সামন্তপ্রভু, তার নীচে ছিল সামন্ত এবং সবার নীচে ছিল প্রজা ও ভূমিদাসগণ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .