মাও-জে-দঙ্ এর নেতৃত্বে চিন কীভাবে কমিউনিস্ট দেশরূপে আত্মপ্রকাশ করে
ভূমিকা
মাও-জে-দঙের নেতৃত্বে চিন আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে নতুনভাবে এক কমিউনিস্ট রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মাও-জে-দঙ্ চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথমশ্রেণির নেতৃত্ব পদে অসীন হন। প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি চিনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একচ্ছত্র নায়ক ছিলেন। ঐতিহাসিক ফ্রিডম্যানের মতে – আধুনিককালের আন্তর্জাতিক ঘটনার ক্ষেত্রে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় শক্তিরূপে চিনের আত্মপ্রকাশ।
কমিউনিস্ট কুয়োমিনটাং ঐক্য
মাও-জে-দঙ্ ছিলেন চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান। অন্যদিকে কুযোমিনটাং দলের প্রধান ও চিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি মার্শাল চিয়াং-কাই-শেক ছিলেন কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী। মাও-জে-দঙ্ কিয়াংসি অঞ্চলে কৃষকদের দিয়ে গড়ে তোলেন ‘লালফৌজ’ (১৯২৮ খ্রিঃ)। চিয়াং-কাই-শেক এই লালফৌজকে ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠালে চিনে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়। কিন্তু সিয়াং ফু ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘সিয়াং চুক্তি’ দ্বারা কুয়োমিনটাং ও কমিউনিস্টরা চিনের বুকে জাপানি আক্রমণের মোকাবিলা করতে জোটবদ্ধ হয়। চিয়াং ও মাও ওই সম্মিলিত বাহিনী পরিচালনার ভার নেন। এই সময় চিনারা যৌথভাবে জাপানি আক্রমণ প্রতিরোধও করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এই ঐক্য বজায় ছিল।
লঙ্ মার্চ
চিনের কিয়াংস প্রদেশ ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলে কমিউনিস্টরা শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করলে চিয়াং -কাই-শেক কিয়াংসি অবরোধ করে তাদের ধ্বংস করতে উদ্যত হয়নি। নিজেদের রক্ষার জন্য মাও-জে-দঙ্ এর নেতৃত্বে পরিবার পরিজনসহ প্রায় একলক্ষ কমিউনিস্ট দক্ষিণ চিনের কিয়াংসি প্রদেশ ছেড়ে (১৯৩৪ খ্রিঃ ১৬ অক্টোবর) উত্তর-পশ্চিম চিনের পীত নদীর বাঁকে এসে আশ্রয় নেন। চিনা কমিউনিস্টদের এই দীর্ঘ ৬ হাজার মাইল (৯,৬০০ কিমি) পদযাত্রা ইতিহাসে ‘লঙ্ মার্চ’ নামে পরিচিত।
কমিউনিস্টদের পিকিং দখল
ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও সামরিক শক্তির সহায়তায় মাও-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা একের পর এক চিনের বিভিন্ন ভূখন্ড দখল করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চিয়াং সরকারকে যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে কমিউনিস্টরা পিকিং দখল করে (১৯৪৯ খ্রি.)।
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রিত কাঠামো
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত অনুগত রাষ্ট্রগুলির ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে বজায় রাখতে সোভিয়েত রাশিয়া যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলেছিল তার দুটি দিক ছিল— অর্থনৈতিক ও সামরিক। আসলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে আমেরিকার মার্শাল পরিকল্পনার প্রলোভন থেকে রক্ষা করে সেখানে সাম্যবাদকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যই সোভিয়েত রাশিয়াকে এরকম একটা শক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বাধ্য করেছিল।
1. অর্থনৈতিক ক্ষেত্র
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলির মধ্যে আর্থিক ক্ষেত্রে সংহতি গড়ে তুলতে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গঠন করা হয় পারস্পরিক আর্থিক সহায়তা পরিষদ (Council for Mutual Economic Assitance) বা কমিকন (Comecon)। এছাড়া দেশগুলির আর্থিক পুনরুজ্জীবনের জন্য দ্রুত শিল্পায়ন, কৃষিক্ষেত্রে যৌথ খামার ব্যবস্থার প্রবর্তন ইত্যাদি নীতি গ্রহণ করা হয়।
2. সামরিক ক্ষেত্র
সামরিক দিক থেকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিকে সোভিয়েত রাশিয়ার ওফর নির্বরশীল করে তোলার জন্য ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ওয়ারশ চুক্তি সংস্থা’ (W.P.O) গঠন করা হয়। তদানীন্তন সোভিয়েত প্রতিরক্ষামন্ত্রী বুলগানিন সংস্থাটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণের চরিত্র
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত সম্প্রসারণের কয়েকটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সেগুলি হল—
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী প্রস্থিতির সুযোগে ওই অঞ্চলে সোভিয়েত রাশিয়ার আধিপত্য তথা সাম্যবাদী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- পূর্ব ইউরোপের ওইসব দেশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নিজ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত করেনি।
- সোভিয়েত-বংশবদ বিশেষত স্ট্যালিনের একান্ত অনুগত ব্যক্তিকেই ওইসব অঞ্চলের শাসক হিসেবে মানা হত।
- ওইসব রাষ্ট্রে স্থানীয় জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বা জাতীয় স্বার্থ ও আর্থসামাজিক স্বাতন্ত্র্য বলে কিছুই ছিল না— স্ট্যালিনই ছিলেন শেষকথা।
- ওইসব রাষ্ট্রে অ-কমিউনিস্ট বা সোভিয়েত তথা স্ট্যালিন বিরোধীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হত। গুপ্তহত্যা হত যথেচ্ছ।
উপসংহার
পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। সোভিয়েত রাজনীতি বিশেষজ্ঞ হিউ সেটন ওয়াটসন তাঁর ‘দ্য ইস্ট ইউরোপনীয়ান রেভোলিউশান’ গ্রন্থে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত প্রাধান্য এক ‘সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা’ বলে উল্লেখ করেছেন। আবার, ডেভিড হরোইউডের মতে – পূর্ব ইউরোপে ঠান্ডা লড়াইয়ের রাজনীতি এবং সোভিয়েত সাম্যবাদকে আটকানোর চেষ্টা সোভিয়েত রাশিয়াকে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিতে সাম্যবাদের প্রসারে আরও উজ্জীবিত করে তুলেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .