নারীদের প্রযুক্তিগত শিক্ষাদান
সমাজ পরিবর্তনের দুটি উল্লেখযোগ্য দিক হ’ল : শিক্ষা ও প্রযুক্তির বিকাশ। সভ্যতার ইতিহাসে দেখা যায়, উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতির সাথে সাথে বিবর্তনের পথে মানুষ কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। এটা অবশ্যই লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যে, মানব-সমাজের বিকাশে নতুন উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কারের সাথে সাথে মানুষ প্রকৃতি ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে নতুন সম্পর্কবোধ সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়। মুদ্রণ প্রযুক্তির বিকাশ মানুষের জ্ঞানের রাজ্যে এখ প্রচণ্ড অগ্রগতি সৃষ্টি করে ও পৃথিবীব্যাপী এর বিস্তারের বিশেষ, গতি দেখা যায়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রভাবে তাই আমরা খাদ্য উৎপাদনে বিশাল পরিবর্তন দেখতে পাই। অবশ্য প্রযুক্তি ব্যাপক হারে মানুষের ধ্বংস অনিবার্য করে ফেলেছে, তাই আজ সঠিক প্রযুক্তির প্রশ্ন এত অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক কালে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ এক ব্যাপক বিষয় হিসাবে চিহ্নিত, যেমন দেখা গিয়েছে মানব-সমাজের বিকাশের গোড়ার দিকে অর্থাৎ পরিবর্তন যখন মানুষকে অভিযোজনীয় পরিবর্তন আনতে বাধ্য করেছিল। মানব-সমাজের কাহিনী একটি বিশেষ ধাঁচের শিল্প বা কারিগরীর পদ্ধতি বা অন্যকিছু সৃষ্টি যা মানুষের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলে, তার কাহিনী বলে মনে হয়। নতুন প্রযুক্তি সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে নতুন শিক্ষার প্রয়োজন এবং তা মানব সম্পর্কের মধ্যে যথাযথ পরিবর্তনও আনে। এ কারণে সমাজ পরিবর্তনের জন্য শিক্ষা ও প্রযুক্তির গুরুত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করা উচিত।
শিক্ষাই ব্রিটিশ যুগে ভারতীয়দের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে মৌলিক ও স্থায়ী পরিবর্তন এনেছিল। শিক্ষাই সমাজে নতুন প্রতিষ্ঠান, জ্ঞান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করেছে। আধুনিক জীবনধারা সৃষ্টি, প্রাগসর যোগাযোগ ব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, আইন ও বিচার ব্যবস্থায় অধিক হারে ভারতীয়দের অংশ গ্রহণ এবং ক্রমবর্দ্ধমান রাজনৈতিক কার্যাবলী সম্ভব হয়েছে শিক্ষার দ্বারা। স্কুল ও কলেজের বিস্তার ও মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে ভারতের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের মদ্যে যথেষ্ট পরিমাণে আধুনিক ও সনাতন জ্ঞান বিতরণ সম্ভব হয়। বই, পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রের প্রকাশন জনগণের কাছে জ্ঞানের জগতের সীমারেখাকে এগিয়ে দেয়।
সাধারণভাবে সমাজ-পরিবর্তনের পথে ও সংস্কৃতয়াণ, পশ্চিমীকরণ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয় চেতনার উদ্বোধনে শিক্ষা যথেষ্টই অবদান রেখেছে।
সমাজে জনসাধারণের এক বিশেষ, অংশের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধিতে শিক্ষা একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। শহরাঞ্চলে কর্মসৃষ্টির সুযোগের বাইরেও শিক্ষিত-সমাজে বিশেষ আত্ম-মর্যাদাবোধের সৃষ্টি করেছে শিক্ষা। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য কমাতে ও শিক্ষিত জনসমাজের সংহতি বাড়াতে শিক্ষা বিশেষভাবে কার্যকরী। ভারতীয় জনসমাজের সমস্ত অংশ যদিও সমানভাবে শিক্ষার সুযোগ পায়নি; তবুও মূল্যবোধ, আচরণ ও জীবনধারায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ও সমাজে নতুন আদর্শ সৃষ্টিতে শিক্ষা অবশ্যই বিশেষ অবদান রেখেছে।
গ্রামাঞ্চলে কোন বিশেষ জাতের প্রাধান্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে শিক্ষাকেই একটি বিশেষ, বৈশিষ্ট্য বলে ধরা হয়। জাতপাত ব্যবস্থায় শিক্ষাই উল্লম্বী সচলতা (upward mobility) ঘটাতে সাহায্য করে। সাধারণতঃ জাতপাতের ক্ষেত্রে সংস্কৃতায়াণের ফলে উল্লম্বী সচতলা ঘটে থাকে। অবশ্যই শিক্ষার ফলেই এ সমস্ত ঘটে থাকে।
পশ্চিমীকরণের শক্তিগুলি শিক্ষার জোরে কার্যকরী হয়। পশ্চিমীকরণ পুরানো প্রথার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল (সতী প্রথা, শিশুবিবাহ, বর্ণাশ্রম ইত্যাদি) ও নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করে (যেমন সংবাদপত্র, নির্বাচন, আমলাতন্ত্র, আইন ও বিচার ইত্যাদি) ও নতুন প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি করে (যেমন সংবাদপত্র, নির্বাচন, আমলাতন্ত্র, আইন ও বিচার ইত্যাদি। পশ্চিমীকরণ মানবিকতাবাদের মূল্যবোধ সৃষ্টি করে যা মানব-হিতের জন্য বর্ণ, অর্থ, ধর্ম, বয়স ও নারী-পুরুষ প্রভৃতি নির্বিশেষে সচেতনভাবে কার্যকর থাকে।
শিক্ষা ভারতে আধুনিকীকরণের প্রভাবকে মসৃণ করেছে। পশ্চিমী দেশগুলির সঙ্গে তাদের চিন্তাধারা, মূল্যবোধ, আকাঙ্ক্ষা ও সংস্কৃতির লেনদেনের পথও এর ফলে জোরদার হয়ে ওঠে। এই সময়ে সমাজ-চিন্তার ক্ষেত্রে শিক্ষা অবশ্যই বিশেষ, অবদান রেখেছে ও প্রবুদ্ধীকরণের শক্তিগুলিকে উদ্দীপ্ত করেছে। রাজা রামমোহন রায় বাংলায় নবজাগরণের সূত্রপাত করেন।
শিক্ষা ভারতীয় সমাজে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র প্রক্রিয়াকে সহজতর করেছে। ধর্মীয় বলতে আগ যা বোঝাত ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বলতে এখন আর তা বোঝায় না এবং সমাজের বিভিন্ন দিকে, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন ও নৈতিকতায় এর বিভিন্ন প্রায়োগ আছে। প্রচলিত বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও মতবাদের পরিবর্তন হিসেবে এই ব্যবস্থা যুক্তিবাদী আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রসার করেছে।
শিক্ষা ভারতে জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার পথ প্রস্তুত করেছে। এদেশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ই স্বাধীনতা আন্দোলনে মূল নেতৃত্ব দিয়েছেন।
স্বাধীনোত্তর ভারতে শিক্ষাকেই দ্রুত সমাজ পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নতি ও সমাজে আধুনিকতার ভিত্তিপ্রস্তর বলে মনে করা হয়। সমাজের নিম্নশ্রেণীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিক্ষা এক নির্দ্ধারক ভূমিকা পালন করেছে। যাই হোক, শিক্ষার ক্ষেত্রে সমান সুযোগই ভারতের বিশাল জনগণকে সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
ভারতে ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থাই শিক্ষিত বেকার সমস্যরা সৃষ্টি করেছে। আমাদের শিক্ষা নীতিকে নতুন ধারায় পরিচালিত করার এটা যথেষ্ট উপযুক্ত সময়। আমাদের সমাজের পরিবর্তিত প্রয়োজনের জন্যই নয়া শিক্ষা নীতি তৈরী হয়েছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .