পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে মৌসুমিবায়ুর প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গ ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত হওয়ায়, এই রাজ্যের জলবায়ুর ওপর মৌসুমিবায়ুর প্রভাব খুবই বেশি হয়। গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসা জলীয়বাষ্প পূর্ণ মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে প্রবল ঝড়বৃষ্টি হয়। আবার শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিকের স্থলভাগ থেকে আসা শীতল ও শুকনো মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এই রাজ্যে বৃষ্টিহীন শীতল জলবায়ু দেখা যায়।
● (১) (জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস) গ্রীষ্মের দাবদাহের পরে আর্দ্র গ্রীষ্ণকাল বা বর্ষা আসে তার শীতল বারিধারা নিয়ে। জুন মাস থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হতে থাকে। এই দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে ১৫ই জুনের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বৃষ্টিপাত শুরু হয়।
● (২) “মৌসিম” একটি আরবি শব্দ, এর অর্থ ‘ঋতু’। অর্থাৎ ‘মৌসম’ বা ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বায়ু প্রবাহও পরিবর্তিত হয়। বর্ষাকালে এই বায়ু প্রবাহ দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আসে। আবার শীতের সময় এই বায়ু সম্পূর্ণ উল্টোদিক থেকে অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসে। দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে আসে বলে বর্ষাকালের মৌসুমি বায়ুপ্রবাহকে দক্ষিণ পশ্চিম
মৌসুমি বায়ু বলা হয়।
● (৩) বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে আসার সময় এই বায়ু প্রচুর জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিকে কোনো পর্বতমালা না থাকায়, বাধা না পেয়ে এ বায়ু সোজা উত্তরবঙ্গে চলে আসে এবং হিমালয় পর্বতে প্রতিহত হয়ে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টিপাত ঘটায়। এ সময় দার্জিলিং-এ প্রায় ৪০০ সেন্টিমিটারের মতন বৃষ্টিপাত হয়। ক্রমে ক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু রাজ্যের অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
● (৪) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সাহায্যে এই রাজ্যের কৃষকরা জমিতে ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষ করে। এই ফসলের উপর পশ্চিমবঙ্গের জনজীবন ও অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল।
● (৫) প্রধানত মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের বার্ষিক বৃষ্টিপাত প্রায় ১৭৫ সেন্টিমিটার হলেও এর মধ্যে প্রায় ১২৫ সেন্টিমিটার গড় বৃষ্টিপাত বর্ষাকালেই হয়। তবে এই রাজ্যে প্রত্যেক বছর একই রকম বৃষ্টিপাত । না, কোনো কোনো বছর অনাবৃষ্টি বা খরা, আবার কোনো কোনো বছর অতিবৃষ্টি বা বন্যা হয়। মৌসুমী বায়ুর আগমন বা প্রত্যাবর্তনও বছরের ঠিক একই সময়ে হয় না। এই সব মিলিয়ে মৌসুমি বৃষ্টিপাতের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তার ভাব দেখা যায়।
● (৬) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তার জন্য কখনও কৃষকেরা জমিতে চারাগাছ লাগিয়ে বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু বৃষ্টি দেরিতে হওয়ায় চারাগাছ শুকিয়ে মরে যায়। কখনও বা জমি তৈরি করবার আগেই বৃষ্টি এসে যাচ্ছে, ফলে জমি জলে ডুবে যাচ্ছে; জমি তৈরি ও চারাগাছ লাগানো সম্ভব হচ্ছে না।
● (৭) মৌসুমি বৃষ্টিপাতের অসম বন্টনের ফলে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ও উত্তর অঞ্চলে মাঝে মাঝে প্রবল বন্যা দেখা দেয়। সংকীর্ণ স্থানে বেশ কয়েকদিন ধরে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে নদীগুলো ফুলে ফেঁপে ওঠে। নদীখাতে পলি জমে জলনিকাশী ব্যবস্থা নষ্ট হওয়ায় ঐ জমা জল দুকূল প্লাবিত করে বন্যার সৃষ্টি করে।
● (৮) ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি, এই তিন মাস স্থায়ী শীতকালে মৌসুমি বায়ু উত্তর পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে শীতের মৌসুমি বায়ুকে উত্তর-পূর্ব মৌসুমিবায়ু বলে।
● (৯) উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত বিশেষ হয় না। কারণ দেশের ভিতরের দিক থেকে উৎপন্ন হওয়া এই বায়ু সমুদ্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ পায় না বলে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুতে জলীয়বাষ্প প্রায় থাকে না বললেই চলে। তবে এই বায়ুপ্রবাহের প্রভাবে দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলে ঝড়-বৃষ্টি হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .