ভারতে রেলপথ বিস্তারের গুণাগুণ
রেলপথের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ব্রিটিশ শাসকগােষ্ঠীর সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ জড়িত থাকলেও ভারতের অর্থনীতির ওপর রেলপথের প্রভাব অনস্বীকার্য। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে রেলপথের সূচনা হলে কার্ল মার্কস সেই সূচনাকে ভারতে আধুনিক শিল্পায়নের অগ্রগামী দূত বলে স্বীকার করেছিলেন। তাঁর ভাষায়, “The system (Railways) was truely the forerunner of modern industry.”
১) পরিবহনে বিপ্লব
রেলপথ প্রবর্তনের ফলে ভারতের চিরাচরিত পরিবহন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে। পূর্বে স্থলপথে শকট ও নদীপথে নৌকাই ছিল প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সীমিত, ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও বিপজ্জনক। রেলপথের প্রবর্তন হলে কম খরচে দ্রুত চলাচল সম্ভব হয়।
২) আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা
রেলপথে পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতির ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষিপণ্য এবং অন্যান্য মাল চলাচলের সুযােগ বৃদ্ধি পায়। রেলমাধ্যমে যেহেতু ব্যয় অপেক্ষাকৃত কম সেহেতু অল্প ব্যয়ে পরিবহনের ফলে বিভিন্ন বস্তুর বিভিন্ন প্রান্তের চাহিদা মেটানাে সম্ভব হয়। ফলে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের দ্রুত শ্রীবৃদ্ধি হয়।
৩) দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ
রেলপথ বিস্তারের ফলে ভারতে দুর্ভিক্ষ ও খাদ্যাভাব প্রতিরােধ করা সম্ভব হয়। উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে সহজে ঘাটতি অঞলে খাদ্যদ্রব্য বহন করা যায়।
৪) কর্মসংস্থান
ভারতে রেলপথের প্রসার শুরু হলে রেলপথ নির্মাণ, রেলকারখানা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিপুল কর্মসংস্থানের সুযােগ হয়। দেশের ভূমিহীন কৃষকরা অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে রেলের কাজে নিযুক্ত হয়। ১৮৯৫ খ্রিঃ ভারতীয় রেলে নিযুক্ত মােট কর্মীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২ লক্ষ ৭৩ হাজার।
৫) যােগাযােগ
আধুনিক জীবনে আধুনিক যােগাযােগ ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটল রেল যােগাযােগ ব্যবস্থায়। রেলপথ ভারতবাসীর যােগাযােগ ব্যবস্থাকে অনেক বেশি এগিয়ে দেয়। সহজ, দ্রুততর এবং আরামদায়ক ভ্রমণ তখন রেলব্যবস্থা ছাড়া অন্য কোনাে বিকল্প পরিবহনে ছিল না। সাধারণ জনজীবনের সাংস্কৃতিকও অর্থনৈতিক জীবনে রেল যােগাযােগ সত্যিই বৈপ্লবিক।
৬) অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ
রেলের একই কামরায় জাতপাতের বিধিনিষেধ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার করা সম্ভব ছিল না। দ্বিজ-অদ্বিজ, ভদ্রলােক-কুলি মজুরের সঙ্গে একই কামরায় পাশাপাশি আসনে উপবিষ্টহয়েছে। তাই বলা যায়, রেলের যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা পরােক্ষে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
৭) জাতীয়তাবােধ
রেলপথের দ্বারা ভারতের এক অঞ্চলের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের যােগাযােগ ও যাতায়াত বৃদ্ধি পায়। ভারতীয় ঐক্য ও শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে মতের আদান-প্রদান বাড়ে। এর ফলে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবােধের সঞার হয়।
এ তাে গেল চিত্রের একটা দিক। চিত্রের অপর দিকটাও প্রণিধানযােগ্য। রেলপথ ভারতের সবক্ষেত্রে আশীর্বাদ ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিশাপও ছিল না।
১) সম্পদ বহির্গমন
রেলপথ নির্মাণের জন্য বার্ষিক ৫ শতাংশ হার সুদে গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বিদেশী মূলধন বিনিয়ােগ করা হয়। এর ফলে সুদ ও মুনাফা হিসাবে প্রচুর পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর ইংল্যান্ডে চলে যেত। এককথায়, রেলব্যবস্থা ভারতীয় সম্পদের বহির্গমনের সুযােগ করে দেয়।
২) ভারতীয়দের করের বােঝা
গ্যারান্টি প্রথার মাধ্যমে ব্রিটিশ রেল কোম্পানিগুলিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাইয়ে দেওয়া হয়। সেই অর্থ কর হিসাবে ভারতীয়দেরই বহন করতে হয়।
৩) জলপথ ও সেচের ক্ষতি
দেশের বিস্তীর্ণ অংশে রেলপথ এবং নদী-নালার উপর রেলের সেতু নির্মিত হলে নদী-নালায় পলি পণ্ডিত হয়ে জলস্রোত কমে আসে এবং নদীর পরিবহনযােগ্যতা হ্রাস পায়। ফলে জলপথে পরিবহন এবং কৃষিজমিতে সেচের কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪) পণ্যৰিক্ৰয়ে প্রতিযােগিতা
রেল যােগাযােগে বিদেশী পণ্য ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও উপস্থিত করানাে হয়। ভারতীয় পণ্যবিক্রয়ের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয়।
৫)শাসনেরাসকঠিন হওয়া
সারা ভারতজুড়ে রেলপথের প্রসারের ফলে ভারতবাসীর ওপর ব্রিটিশ শাসকদের বজ্রমুষ্টি আরও শক্ত হয়। দেশের কোনাে প্রান্তে কোনাে বিদ্রোহ বা বিরােধিতার সামান্য সম্ভাবনা দেখা দিলে রেলপথের মাধ্যমে খুব শীঘ্র সেখানে পৌছে গিয়ে সরকারি বাহিনী তা দমন করতে সক্ষম হয়।
৬) কুটির শিল্প ধ্বংস
রেলপথের মাধ্যমে কলকারখানায় তৈরী সস্তা মাল গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয় কুটির শিল্প প্রতিযােগিতায় বিনষ্ট হয়। বহু লােক বেকার ও জীবিকাহীন হয়ে যায়। ফলে ভারতে দারিদ্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। এজন্য কার্ল মার্কস ১৮৮১ খ্রিঃ সতর্ক করে মন্তব্য করেন যে, “The railways were useless to the Hindus.”
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .