ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতে স্ত্রী শিক্ষার বিস্তার
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজী শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী শিক্ষার প্রবর্তন ও প্রসার ঘটেছিল। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে তেমন কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এই শতাব্দীর প্রথমার্ধে কিছু অভিজাত পরিবার ও খ্রিষ্টান মিশনারিগণ বিক্ষিপ্তভাবে এব্যাপারে উৎসাহিত ছিলেন। ক্রমশ জনসাধারণের মনে স্ত্রী শিক্ষার প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে ওঠে। বাংলা ভাষায় সাহিত্য ক্ষেত্রে স্ত্রী শিক্ষাকে প্রথম সমর্থন করেন গৌরমােহন বিদ্যালঙ্কার তার স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থতে (১৮২২ খ্রিঃ)।
স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে ব্রাহ্মসমাজের ভূমিকা
ভারতে স্ত্রী-শিক্ষা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ছিলেন রাজা রামমােহন রায় ও তার প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ। সে যুগে স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল,নারী শিক্ষা সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। রক্ষণশীল সমাজ এর প্রচণ্ড বিরােধী ছিলেন। এজন্য ব্রাহ্মসমাজ ভারতী’, ভারতমহিলা’, বামাবােধিনী’, ‘অবলা বান্ধব’ প্রভৃতি পত্রিকা প্রকাশ করে। এই পত্রিকাগুলির উদ্দেশ্য ছিল নারীশিক্ষা সম্পর্কে সমাজকে সচেতন। করা। এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বর্ণকুমারী দেবী সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকা। এছাড়া কেশবচন্দ্র সেন স্ত্রী-শিক্ষা ও গণ-শিক্ষার ব্যাপারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়, বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় ও ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়।
স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে আর্য সমাজের ভূমিকা
পাঞ্জাবে আর্যসমাজ স্ত্রী-শিক্ষার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের জন্য আর্যসমাজ জলন্ধরে মহাকন্যা’ বিদ্যালয় স্থাপন করে। উত্তর ভারতেও তারা কয়েকটি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে শুধুমাত্র নারীদের শিক্ষার জন্য।
স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে জ্যোতিবা ফুলে
স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে মহারাষ্ট্রের জ্যোতিবা ফুলে ও তার স্ত্রী প্রয়াস চালান। তারা ১৮৫১ খ্রিঃ পুণায় একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
বাংলা তথা ভারতে স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্ত্রী জাতিকে সামাজিক উপেক্ষা ও অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা করাই ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনের প্রশ্ন, এত। এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৪৯ খ্রিঃ কলকাতায় ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুনকে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। এই বিদ্যালয় ক্রমে বেথুন কলেজে পরিণত হয়। অভিভাবকেরা বেথুন সাহেবের স্কুলে যাতে মেয়েদের পড়তে পাঠায় তার জন্য বিদ্যাসাগর প্রচার করেন। তাঁর প্রচারের ফলে অনেক অভিজাত পরিবারের মেয়েরা বেথুন স্কুলে পড়তে আসে। তিনি স্ত্রীশিক্ষার প্রচারের জন্য স্কুলের গাড়ীতে লিখেছিলেন—“কন্যা পেবং পালনীয়া / শিক্ষা নিয়তি যত্নতঃ”অর্থাৎ কন্যাকে পুত্রের মতাে পালন করে শিক্ষাদান করতে হবে। বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বাংলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই বিদ্যালয়গুলিতে ১৩০০ ছাত্রী পড়ত। গ্রামাঞ্চলে বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তিনি কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন।
স্ত্রী শিক্ষার বিস্তারে সরকারী উদ্যোগ
উডের নির্দেশনামার ৮৩নং ধারায় নারীশিক্ষার প্রসারের জন্য সরকারকে চেষ্টা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই নির্দেশকে কার্যকর করার জন্য বাংলার গভর্ণর হ্যালিডে তৎপর হয়েছিলেন। ১৮৭১ থেকে ১৮৮২ খ্রিঃ মধ্যে নারীশিক্ষার দ্রুত প্রসার ঘটে। ১৮৭৩ খ্রিঃ সমস্ত ভারতে ১,৬৪০টি বালিকা বিদ্যালয় ছিল। ১৮৮২ খ্রিঃ হান্টার কমিশন নারীশিক্ষার ব্যাপারে হতাশা প্রকাশ করে। হান্টার কমিশন নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য সুপারিশ করে যে, নারী বিদ্যালয় স্থাপনে সরকারী অনুদান দেওয়া দরকার। কমিশন আরও সুপারিশ করে পৌরসভা ও প্রাদেশিক সরকারকে নারীশিক্ষার জন্য ব্যয়ভার গ্রহণ করতে হবে। এর ফলে সরকারী উদাসীনতা হ্রাস পায়।
বিংশ শতকে স্ত্রী শিক্ষার অগ্রগতি
বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই স্ত্রী-শিক্ষা প্রসারের জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চলতে থাকে। তবে বেসরকারী উদ্যোগ বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। ঐ সময়ে ভারতে ৪৬১টি বালিকাদের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। ১৯০১-০২ খ্রিঃ ভারতে মহিলা কলেজের সংখ্যা ছিল ১২টি। ভারতে প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন ধন্দো কেশব কার্ভে।
এইভাবে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মধ্যে নারীশিক্ষা যথেষ্ট প্রসার লাভ করে। তবে নারীশিক্ষার প্রসার শুধুমাত্র শহরের উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামাঞ্চলে নারীশিক্ষার তেমন প্রসার ঘটেনি।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .