ভারতীয় সমাজের উপর পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তনের প্রভাব
ঊনবিংশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ছিল ব্যাপক ও বহুমুখী। কারণ, শিক্ষার প্রসারের পাশাপাশি পশ্চিমি আদর্শ ভারতের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে এনেছিল গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন।
১)নবযুগের সূচনা
পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ফলে ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলােকপ্রাপ্ত ভারতবাসী আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তারা রাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছিল। ফলে ভারতীয়দের মধ্যে এক নবচেতনার জন্ম হয়েছিল ও ভারতে নবযুগের সূচনা হয়েছিল।
২) শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতে একদল ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে এবং এঁদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। এঁরা নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল। এই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছিল চাকরি উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক, অধ্যাপক প্রমুখ। এঁরা ছিলেন যুক্তিবাদী এবং সংস্কারকামী।সমাজ ও ধর্মসংস্কারের ক্ষেত্রে এঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
৩) জাতীয়তাবাদের উদ্ভব
ঊনিশ শতকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের প্রভাবে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটে। ভলটেয়ার, রুশাে, ম্যাসিনি, মিল, লক, টমাস পেইন, এডমণ্ড বার্ক প্রমুখ পাশ্চাত্য দার্শনিকের চিন্তাধারা থেকে ভারতবাসী জাতীয়তাবাদী আদর্শ, যুক্তিবাদ ও মানবতার শিক্ষা গ্রহণ করে। ফরাসী বিপ্লব, জার্মানি ও ইটালির ঐক্য আন্দোলন, বল্কান জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এই আদর্শগুলিকে শিক্ষিত ভারতীয়রা ভারতীয় সমাজে বাস্তবায়িত করতে সচেষ্ট হয় এবং এরই প্রভাবে ভারতে গড়ে ওঠে জাতায়ীতবাদী চেতনা। তাই আলফ্রেড লায়াল ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারকে ব্রিটিশ সরকারের ‘A Story of grave Political miscalculation‘ বলে মন্তব্য করেছেন।
৪) সমাজ সংস্কার আন্দোলন
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে ভারতে সমাজ সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। শিক্ষিতসম্প্রদায় ভারতের চিরাচরিত অন্ধবিশ্বাসও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। সমাজসংস্কারকদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন রাজা রামমােহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডিরােজিও, রামকৃয়-বিবেকানন্দ প্রমুখ। এঁরা ভারতীয় সমাজ থেকে সতীদাহ প্রথা, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি দূর করতে এবং বিধবাবিবাহ, নারীশিক্ষা প্রভৃতির প্রসারের জন্য আন্দোলন করেছিলেন।
৫) ধর্মীয় আন্দোলন
পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রভাবিত হয়ে বেশ কিছু ধর্মসংস্কারকের নেতৃত্বে। এসময় শুরু হয় ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে আর্য সমাজ সনাতন হিন্দুধর্মকে গণমুখী ও জনপ্রিয় করে তােলার চেষ্টা করে। ব্রায় সমাজের নেতৃত্বে পৌত্তলিকতাবাদের বিরােধিতা শুরু হয়। থিওসফিক্যাল সােসাইটির উদ্যোগে গড়ে ওঠা আন্দোলন হিন্দুধর্মের নব উত্থানে সাহায্য করে।
৬)নারীশিক্ষার প্রসার
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় নারী শিক্ষা বিস্তারে। প্রাক্ ব্রিটিশ পর্বে ভারতে নারীশিক্ষার বা বালিকা বিদ্যালয়ের তেমন ঐতিহ্য ছিল না। কিন্তু শ্রীমতি কুক ও লণ্ডনের চার্চ মিশনারী সােসাইটি, ফিমেল জুভেনাইল সােসাইটির উদ্যোগে নারী শিক্ষার সূচনা ও প্রসার ঘটে। আবার বেথুনের উদ্যোগ্নে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় ও বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে বাংলায় প্রায় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। চাল উডের প্রতিবেদনে নারীশিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
৭) জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে উনিশ শতকে বেশ কিছু জাতীয়তাবাদী সাহিত্য সৃষ্টি হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্যপন্থী গদ্য সাহিত্যের সৃষ্টি হয়। রামমােহন রায়, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সাহিত্য ও কাব্যে পাশ্চাত্য প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। হিন্দি সাহিত্যিক পদ্মাকর ভট্ট, গােকুলনাথ ও চন্দ্রশেখর সৃষ্ট সাহিত্যগুলিতেও পাশ্চাত্য প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট।
পাশ্চাত্য শিক্ষার বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ছিল।
১) বেকারত্ব বৃদ্ধি
ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ারের মতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের ফলে মুসলিম মৌলানা ও সংস্কৃত পণ্ডিত বা হিন্দু চিকিৎসক, মুসলিম হাকিমরা ক্রমশঃ তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে এবং বেকার হয়ে পড়ে।
২) স্বল্প সংখ্যক মানুষের শিক্ষার সুযােগ
পাশ্চাত্য শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজি ভাষা। ফলে সমাজের অল্প সংখ্যক মানুষের পক্ষে এই শিক্ষা গ্রহণের সুযােগ আসে।
৩) শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব মূলতঃ শহরাঞলেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ ভারতে এর প্রভাব ছিল স্বল্প। আবার বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি শিক্ষা অবহেলিতই থেকে গিয়েছিল।
মূল্যায়ন
পরিশেষে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বলা যায় ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন ছিল। এক দিচিহ্ন, তা যেমন ভারতীয় সমাজ শিক্ষা জীবনের ওপর প্রভাব ফেলেছিল তেমনই ভারতের সমাজ সংস্কৃতিতে একটি বহিরাগত চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল। ভারতবাসী পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই এই চ্যালেঞ্জকে মােকাবিলা করেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .