আকবরের ধর্মনীতি
আকবরের শ্রেষ্ঠত্ব
আশাতীত পার্থিব সাফল্য অর্জন করা সত্ত্বেও আকবর ছিলেন যথার্থ ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। তার উদার মনােভাব এবং গভীর ধর্মজ্ঞানের ফলে তিনি সর্বপ্রকার গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন। সেইজন্যই তিনি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর স্বাভাবিক আনুগত্য লাভ করে একটি স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি বলতেন সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টির মধ্যে একটি ঐক্যসূত্র আছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তার মতে কল্পনা শক্তির দ্বারাই নিরাকারকে অনুমান করা যায়। তিনি একটি ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করে পরমধর্মসহিষ্ণুতাকে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে আধুনিকতার অগ্রদূত হিসাবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন।
রাজ্যসভায় পন্ডিতবর্গের সমাবেশ
উদার ধর্মনীতির কারণ
বিভিন্ন প্রভাবের ফলেই আকবরের উদারধর্মনীতি গড়ে উঠতে পেরেছিল।
(১) আকবর যে শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেই ষােড়শ শতাব্দী ছিল অনুসন্ধিৎসা ও জ্ঞানান্বেষণের যুগ; বিশ্বের বিভিন্ন সভ্য কেন্দ্রে যে নব জ্ঞানােন্মেষ দেখা গিয়েছিল, আকবরের ন্যায় চিন্তাশীলগণকেও তা প্রভাবিত করেছিল।
(২) কবীর, নানক প্রমুখ ভারতীয় নবীন ধৰ্মচাৰ্যগণ পূর্বেই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও ধর্মনীতির প্রচার করে আকবরের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন।
(৩) তৈমুরের বংশধরগণ উকট ধর্মান্ধতার বদলে বেশীর ভাগই ছিলেন সুফী মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত। আকবরের পিতা ও পিতামহেরও কোনাে গোঁড়ামি ছিল না। তার মাতা হামিদা বানুর উদারতা, মানসিক উৎকর্তা ও পরধর্মসহিষ্ণুতা তাঁকে বাল্যকাল থেকেই যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল।
(৪) প্রথম জীবনেই তিনি পারস্য থেকে আগত সুফী পন্ডিতগণের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং উদার আবদুল লতিফের নিকট থেকে শিক্ষালাভ করেছিলেন।
(৫) তার উদার ধর্মনীতির ফলেই তিনি। রাজপুত রমণীদের বিবাহ করেছিলেন, তাদের প্রভাব তার উদার ধর্মভাব বৃদ্ধিতে আরও সাহায্য করেছিল।
(৬) তাঁর রাজসভায় নানা ধর্মাবলম্বী জ্ঞানীগুণীর সমাবেশ ঘটেছিল। তাদের সঙ্গে আলােচনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন ধর্মের সার কথা যে একই তা তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এবং এর ফলে তিনি পরমধর্মসহিষ্ণু ও ধৰ্মৰ্য্যাপারে উদার হয়ে ওঠেন, শেখ মােবারক এবং তার পুত্রদ্বয় ফৈজী ও আবুল ফজলের পান্ডিত্যপূর্ণ আলােচনা এই ব্যাপারে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
ধর্মজীবনের তিন পর্যায়
সুন্নী মুসলমান
ধর্মজীবনের বিকাশ
আকবরের ধর্মজীবনকে মােটামুটিভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়ে অর্থাৎ ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সুন্নী মুসলমান হিসেবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি মেনে চলেছিলেন। তার চিন্তাধারায় ধীর পরিবর্তন বাহ্যিক কোনাে কর্মধারার বিশেষ কোনাে পরিবর্তন আনেনি। তীর্থযাত্রা, নামাজ পাঠ প্রভৃতি তিনি করতেন। সেই বছরই তিনি শেষবারের মতাে তীর্থযাত্রী রূপে আজমীর গিয়েছিলেন। ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তীর্থযাত্রী কর রদ করেন। ও ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে জিজিয়া কর রহিত করেন।
ইবাদাৎখানা
দ্বিতীয় পর্যায়
১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দের পর থেকেই তার ধর্মজীবনের দ্বিতীয় পর্যায় আরম্ভ হয়। আকবর এই সময় থেকে ইসলামধর্মের অনুষ্ঠানাদির ওপর আস্থা হারাতে থাকেন। তিনি কখনােই নিজের ধর্ম বিশ্বাসকে রাষ্ট্রীয় কার্যে চাপিয়ে দেননি। ধর্মীয় গোঁড়ামিকে কখনােই প্রশ্রয় দেননি, ‘আত্মা অবিনশ্বর ও পরমাত্মার অংশ। বিশেষ’ এই ধারণা পােষণ করেন। ধর্মালােচনার জন্য তিনি ফতেপুর সিক্রিতে (১৫৭৫ খ্রিঃ) একটি ইবাদাৎ স্থাপন করেছিলেন। এখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণ ধর্মকথা আলােচনা করতেন, আকবর তা গভীর মনােনিবেশ সহকারে শ্রবণ করতেন। তুলনামুলক ধর্ম-আলােচনার দ্বারা তিনি প্রকৃত সত্য উদঘাটন করতে চেয়েছিলেন। অবশেষে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, সমস্ত ধর্মের মূল কথাই এক’। তিনি উলেমাদের ধর্মান্ধতা ও নিরস বিতর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। উলেমাদের মধ্যে ধর্মসংক্রান্ত বাদ-বিসম্বাদ বন্ধ করবার উদ্দেশ্যে তিনি একটি নৃতন দলিল ঘােষণা করলেন। ডাঃ স্মিথের মতে এটি অভ্রান্ত কর্তৃত্বের ঘােষণা’ (Infallibity decree, মাহজার)। এই ঘােষণা দ্বারা আকবর নিজে রাষ্ট্র ও ধর্ম ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব গ্রহণ করলেন।
কিন্তু বর্তমান ঐতিহাসিকগণ স্মিথের এই মত সমর্থন করতে পারেন নি। তাদের মতে মুসলমানধর্মের অভ্যন্তরীণ বিরােধের মীমাংসা করা এবং বিভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে একে সকলের গ্রহণযােগ্য করাই ছিল আকবরের মূল উদ্দেশ্য।
দীন-ইলাহীর উদ্দেশ্য ও এর ব্যর্থতার কারণ
তৃতীয় পর্যায়
আকবরের ধর্মজীবনের তৃতীয় পর্যায় আরম্ভ হয় ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে থেকে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে পরস্পর বিদ্বেষ এবং পরধর্ম সম্বন্ধে অসহিষ্ণুতা আকবর কোনাে দিনই মনে-প্রাণে সমর্থন করতে পারেন নি। এখন তিনি একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে এই নূতন ধর্মমতের উদ্ভাবন করলেন। এটি তাঁর দীন-ইলাহী’ নামে পরিচিত। সকল ধর্মের দর্শনই এতে স্থান পেয়েছিল, নানা বিরােধী ধর্মের একটি সমন্বয়ের আদর্শ এতে উপস্থাপিত হয়েছিল। আকবরের ধর্মসহিষ্ণু নীতির চরম-বিরােধী ঐতিহাসিক বদায়ুনি ‘দীন-ই-ইলাহী’-কে একটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্মমত বলে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু দীন-ই-ইলাহীর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এটি কোনাে নতুন ধর্মমত ছিল না। তিনি এই ধর্ম জোর করে কারও ওপর চাপাতে চাহেন নি, প্রচার করবারও নি। আকবর
যদি সত্য সত্যই কোনাে নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী থাকেন তাহলে এই ধর্মের অনুগামীর সংখ্যা এত কম হতাে না। দীন-ই-ইলাহী’র সদস্য সংখ্যা সম্ভবত কুড়ির বেশী ছিল না। ভগবান দাস, মানসিংহ বা টোডরমলের মতাে আকবরের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরাও দীন-ই-ইলাহী’র সদস্যপদ গ্রহণ করেন নি। সুতরাং গভীর ধর্মজ্ঞানে পরিপূর্ণ। ‘দীন-ই-ইলাহী’ জনসাধারণের মনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। ঐতিহাসিক ডক্টর স্মিথ মনে করেন যে দীন-ইলাহী’ আকবরের মূখর্তার চরম নিদর্শন মাত্র। “The Divine faith (Din-Ilahi) was monument of Akbar’s folly and not of his wisdom.”-Smith. বদায়ুনি ও খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের (Jesuites) অনুসরণ করে স্মিথ মনে করেন যে দীন-ই-ইলাহী’র পর থেকে আকবর ক্রমেই ইলাম-বিরােধী হয়ে উঠেন এবং মুসলমানদের ওপর নানাপ্রকার বিধি-নিষেধ আরােপ করতে থাকেন। কিন্তু বায়ুনি বা জেসুইটসদের মতামত নানা কারণে সব সময় গ্রহণযােগ্য নয়। এরা আকবরের রাজনৈতিক ও ধর্মনৈতিক কার্যাবলিকে বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতেন। Dr. Ishwari Prosad বলেছেন “It’s basis was rational; it up held no dogma, recognised no god or prophets. আসল কথা হচ্ছে আকবর সব সময়েই কোরানে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি ঐকান্তিকভাবে। ধর্মসহিষ্ণুতার বিশ্বাসী ছিলেন, তার ধর্মনীতির মূল কথাই ছিল সুল-ই-কুল’ অর্থাৎ পরধর্মসহিষ্ণুতা। এই কারণে অনেক ইওরােপীয় ঐতিহাসিকও তার মানবতাবােধ ও উদারতা উচ্ছ্বসিতভাবে প্রশংসা করেছেন।
আকবরের ধর্মনীতি মােগল-সাম্রাজ্যের শক্তি সুসংহত করার পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। তার নিরপেক্ষ উদার ধর্মনীতি ভারতের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জনগণের মধ্যে ঐক্যবােধ সঞ্চারিত করে। অন্যদিকে এর ফলে রাজনীতির ক্ষেত্রে উগ্র উলেমা সম্প্রদায়ের প্রভাব হ্রাস পায় এবং ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সম্রাটের সময় প্রাধান্য স্থাপিত হয়।
Comment ( 1 )
Nice