ফরাজী আন্দোলন এর বিবরণ
ইসলাম ধর্মের পুনরুজ্জীবনও শুদ্ধিকরণকে কেন্দ্র করে বাংলায় যে আন্দোলনের সূচনা হয়, তা ফরাজী আন্দোলন নামে পরিচিত। মূল আরবী শব্দ ‘ফরাইজ’ থেকেই ফরাজী’কথার উৎপত্তি ‘ফরাইজ’কথার অর্থ হল, যিনি আল্লাহর নির্দেশানুসারে কর্তব্য পালন করেন। এই আন্দোলনের সময়কাল ছিল ১৮১৮ থেকে ১৮৬০ খ্রঃ পর্যন্ত। এই আন্দোলনের সূচনা করেন ফরিদপুরের বন্দর খােলার জনৈক হাজী শরিয়তউল্লাহ। ১৮ বছর বয়সে তিনি মক্কায় তীর্থ ভ্রমণে যান এবং প্রায় ২০ বছর সেখানে কাটান। মক্কায় বিদ্যাচর্চাকালীন তিনি আব্দুল ওহারের সংস্পর্শে আসেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১৮২০ খ্রীঃ বাংলাদেশে ফিরে এসে ফরিদপুর জেলার গ্রামে গ্রামে মুসলীমদের মধ্যে তার ‘ফরাজী’র আদর্শ প্রচার করেন।
শরিয়তউল্লাহর আদর্শ
ওহাবী আন্দোলনের মত ফরাজী আন্দোলনের মূল কথাহল ইসলামের আদি ও অকৃত্রিম আদর্শের পুনরুজ্জীবন। তিনি প্রচার করেন যে, স্থানীয় মুসলমানেরা কোরাণ বিরােধী আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও কুসংস্কার পালন করে পাপ করেছে। সুতরাং ইসলাম আদর্শের পরিপন্থী এইসব আচরণ থেকে বিরত হতে হবে। তিনি আরাে বলেন যে, ইসলামে ধনসম্পদ বা বংশ মর্যাদার ভিত্তিতে ভেদাভেদের কোন স্থান নেই। এখানে সবাই সমান। পীর (প্রভু ও মুরিদ অনুগত ভৃত্য) শব্দদুটির মধ্যে একধরণের ভেদাভেদ বা প্রভু ভৃত্যের সম্পর্কের স্পর্শ আছে বলে তিনি এই দুটি শব্দের পরিবর্তে ওস্তাদ ও শাকরেদ অর্থাৎ শিক্ষক ও ছাত্র কথা দুটি ব্যবহার করতে থাকেন। তিনি ঘােষণা করলেন ব্রিটিশ শাসনে ভারত দার-উল-হার্বে পরিণত হয়েছে এবং প্রত্যেক ভারতবাসী মুসলমানের উচিত ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করা। ফরাজী মতাদর্শের একটি বৈশিষ্ট্য হলাে তাদের মধ্যে এক নিবিঢ় আত্মিক বন্ধন, যা তাদের ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের পরিচায়ক ছিল। ধর্মীয় চিন্তার ক্ষেত্রে ফরাজীরা কিছুটা গোঁড়া ছিল এবং তাদের এই অসহিষ্ণু। মনােভাবের জন্য কোন ক্ষেত্রে তারা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলতাে। তাদের বিরােধী মুসলমানদের প্রতি তারা মাঝে মাঝে জোর জুলুম করত। শরিয়উল্লাহর প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে বহুগরীব মুসলমান কৃষক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তার প্রভাব ক্রমশঃ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। শরিয়উল্লাহর জনপ্রিয়তা গোড়া মৌলবী ও ধনী মুসলমানদের চিন্তান্বিত করে তােলে। জমিদারদের অন্যান্য রাজস্ব আদায়ের প্রতিবাদ করায় তারাও ফরাজীদের বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে।শরিয়উল্লাহকে ঢাকা থেকে বিতাড়িত করা হয়। ফরিদপুর থেকেই তিনি আমৃত্যু তার প্রচারকার্য চালিয়ে যান।
দুদুমিঞা
শরিয়তউল্লাহর মৃত্যুর পর তার পুত্র দুদুমিঞা ফরাজী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। দুদুমিঞার আমলে ফরাজী আন্দোলন ধর্মীয় গন্ডির থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ফমশ আর্থরাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তিনি দাবি করেন যে, জমি ঈশ্বরের দান। তাই জমির উপর জমিদারদের মালিকানা ঈশ্বরের বিধানের বিরােধী। তাই তিনি করদানের বিরােধিতা করেন এবং জমিদারদের কোনরূপ কর দিতে বারণ করেন। এর সাথেনীল চাষ করা থেকে মুসলমানদের বিরত থাকার নির্দেশ দেন। দুদুমিঞার সাংগঠনিক শক্তি ছিল অসাধারণ। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ ফরাজী সম্প্রদায়ের কোন সদস্য বিপদে পড়লে অন্য সকলে তার সাহায্যে এগিয়ে আসত। এক পুলিশ রিপাের্ট থেকেও জানা যায় যে, ১৮৪৩ খ্রীঃ নাগাদ তার অনুগামীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০ হাজার। ফরিদপুরের জমিদার জয়নারায়ণ ঘােষ ও মদননারায়ন ঘােষের বিরুদ্ধে ফরাজীরা তীব্র আন্দোলন চালায়। পাঁচ চরের অত্যাচারী নীলকর ডানলপের অত্যাচারী গােমস্তা কালিপ্রসাদকে তারা হত্যা করে। ১৮৩৮ খ্রীঃ থেকে ১৮৪৭ খ্রীঃ-র মধ্যে দুদুমিঞাকে চারবার গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষীর অভাবে প্রতিবারই মুক্তি পেয়ে যান। মহাবিদ্রোহের সময় তাকে আলিপুর জেলে বন্দী রাখা হয়। বন্দী অবস্থায় তার শরীর ভেঙ্গে যায় এবং তাকে সরকার মুক্তি দেয়। ১৮৬২ খ্রীঃ বাহাদুরপুরে তিনি শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন।
নােয়ামিঞা
এরপর নােয়ামিঞা ফরাজীদের নেতৃত্ব দেন। তিনি আর্থিক সংস্কারের পরিবর্তে ধর্মের উপর বেশি জোর দিলে আন্দোলনের তীব্রতা হ্রাস পায় এবং কৃষক শ্রেণী নিস্পৃহ হয়ে যায়। এর সাথে যুক্ত হয় নীলকর, জমিদার ও সরকারের দমন পীড়ন।
প্রকৃতি
ফরাজী আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ডঃ অভিজিৎ দত্ত ও নরহরি কবিরাজের মতে ফরাজী আন্দোলন ছিল একটি কৃষক আন্দোলন। আবার ডঃ বিনয়ভূষণ চৌধুরীর মতে ফরাজী আন্দোলন একটি ধর্মীয় আন্দোলন। সুপ্রকাশ রায় এর মতে, “ফরাজী আন্দোলন জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণ বৈপ্লবিক রূপ দিয়েছিল।”
ব্যর্থতা
ওহাবী আন্দোলনের মত ফরাজী আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। ওহাবীদের তুলনায় ফরাজীদের সংগঠন হয় এ কিছুটা জোরদার ছিল। তারা কিন্তু ওহাবীদের মত সরাসরি কোন সংঘর্ষে অবতীর্ণ হয়নি। তাই ফরাজী আন্দোলনের ব্যর্থতা অস্বাভাবিক নয়।
প্রথমতঃ সংকীর্ণ ধর্মবােধচেতনার উপর ভিত্তি করে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল বলে সমস্ত কৃষক সম্প্রদায়ের সক্রিয় সমর্থন ও সহানুভূতি এই আন্দোলনে ছিল না। বিশেষতঃ পরবর্তী কালে ফরাজীদের সাম্প্রদায়িকতাবােধ কিছুটা তীব্র আকার ধারণ করেছিল। ফলে হিন্দু কৃষকদের সমর্থন ফরাজীরা পায়নি। দুদুমিঞার স্বাধীন সরকারের ভিত্তি চোরাবালির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
দ্বিতীয়তঃ আন্দোলনের সুস্পষ্ট কোন লক্ষ্য ছিল না। জমিদার ও নীলকদের ক্ষমতানাশ বা তার উপর আক্রমণ ছিল ফরাজী বিদ্রোহের নেতিবাচক দিক। কিন্তু এর ঊর্ধ্বে উঠে কোন সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট ইতিবাচক কর্মসূচী তারা গ্রহণ করেনি। ওয়াহাবীদের মত তারা তীব্র সরকার বিরােধী ছিল না। সুতরাং অস্পষ্ট রাজনৈতিক চেতনা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব ও বাস্তব অভিজ্ঞতার ঘাটতি ফরাজীদের আন্দোলনের ভিত্তি দুর্বল করে দিয়েছিল।
ব্যর্থতা সত্ত্বেও ফরাজী আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনের নেতারা অবহেলিত ও অত্যাচারিত কৃষক সম্প্রদায়ের মনে জমিদার ও নীলকরদের শােষণের বিরুদ্ধে আশার আলাে জ্বালিয়েছিলেন। ধর্মীয় কুসংস্কার ও ইসলাম বিরােধী আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হলেও এর রাজনৈতিক কর্মসূচী ও ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পরিকল্পনা কৃষকদের উদ্দীপ্ত করেছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .