বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন
ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন মহারাষ্ট্রে শুরু হলেও তা বাংলাতেই ব্যাপক প্রসার লাভ করে, বাংলায় ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রথম বিকাশ ঘটে। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে বাংলায় গুপ্তসমিতি গঠনের প্রচেষ্টা দেখা যায়।নব গােপাল মিত্রের নেতৃত্বে হিন্দুমেলা ১৮৭০ খ্রীষ্টাব্দের পর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের উদ্যোগে সঞ্জীবনী সভা গঠিত হয়। ইহা যুব সম্প্রদায়কে সংগঠিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। অবশেষে বিংশ শতাব্দীর সূচনায় বাংলায় রাজনৈতিক ভাবে গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়। কলিকাতায় তিনটি এবং মেদিনীপুরে একটি গুপ্ত সমিতি গঠিত হয় এই সকল সমিতির মধ্যে উল্লেযােগ্য ছিল অনুশীলন সমিতি। অনুশীলন সমিতির ইতিহাসের সঙ্গে প্রমথ মিত্রের নাম ওতপ্রােত ভাবে জড়িত। বঙ্কিম চন্দ্রের “আনন্দমঠ” গ্রন্থ থেকে এই নাম গৃহীত হয়। সতীশচন্দ্র বসু ও অন্যান্যদের অনুরােধে প্রমথ মিত্র অনুশীলন সমিতির সভাপতি হন। স্বামী বিবেকান্দের আদর্শ অনুযায়ী অনুশীলন সমিতির সদস্যদের ব্যায়াম চর্চা, মুষ্টিযুদ্ধ ও লাঠি চালনার মাধ্যমে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে স্বদেশ প্রেম ও বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে সচেতন করা হত।
১৯০৫ সালে বাংলায় বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রস্তুতি
১৯০৫ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেও অনুশীলন ও অন্যান্য সমিতিগুলি শরীর চর্চা, লাঠি খেলা প্রভৃতি কাজে নিয়ােজিত ছিল। কিন্তু সক্রিয় কার্যকলাপ জড়িত ছিল না। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়। এর পর বাংলায় বৈপ্লবিক আন্দোলন নতু রূপ পরিগ্রহ করে। ডঃ সুমিত সরকার এই মত পােষন করে যে, “১৯০৫ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা না হলে বাংলায় বিভিন্ন সমিতিগুলি ঊনবিংশ শতাব্দীর সঞ্জীবনী সভার মত স্তিমিত হয়ে পড়ত”। বাংলায় বৈপ্লবিক তৎপরতা প্রকাশ্য ও গােপন দুটি খাতে প্রবাহিত হয়েছিল। একটি নিস্ক্রিয় গােষ্ঠি প্রতিরােধের মাধ্যমে প্রকাশ্যভাবে আন্দোলন পরিচালনার পক্ষপাতি ছিল। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্র বিফল করার উদ্দেশ্যে গুপ্তহত্যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়। হিংসাত্মক আন্দোলন পরিচালনার ক্ষেত্রে বারিন্দ্র কুমার ঘােষ, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, অবিনাশ ভট্টাচার্য প্রমুখ ব্যক্তিরা প্রধান ভূমিকা পালন করেন। অরবিন্দ ঘােষের ভ্রাতা বারিন্দ্র কুমার ঘােষ আন্দোলন গড়ে তােলার কাজে সক্রিয় হন। জনগণের মধ্যে বৈপ্লবিক আদর্শের প্রচারের উদ্দেশ্যে ভবানী মন্দির”নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৯০৬ খ্রীঃ যুগান্তর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এবং এই পত্রিকার মাধ্যমে বারিন্দ্র কুমার ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের আদর্শ প্রচার করেন। এছাড়া অরবিন্দ ঘােষ“বন্দে মাতরম” পত্রিকায় গীতার কর্মযােগের ব্যাখ্যার দ্বারা বিপ্লবীদের অভয় মন্ত্রে দীক্ষিত করেন।
১৯০৭ সালে বাংলায় বৈপ্লবিক আন্দোলনের কার্যকলাপ
১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে সরকার ওয়াকিবহাল ছিলেন না, গুপ্ত হত্যার প্রথম অভিব্যক্তি ঘটে। ১৯০৭ খ্রীঃ ডিসেম্বর মাসে পূর্ববঙ্গের লেফটেন্যান্ট গর্ভনর ব্যামফিল্ড ফুলারকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়, এদিকে বারিন্দ্র কুমার ঘােষ হেমচন্দ্র কানুনগাে, উল্লাসকর দত্ত প্রমুখ মানিক তলার কাছে মুরারি পুকুর অঞলে বােমা প্রস্তুত করার জন্য কারখানা গড়ে তােলেন। এই গুপ্ত সমিতি ইংরেজ কর্মচারীদের হত্যা করে শাসন তন্ত্রকে বিকল করার পন্থা গ্রহণ করেন। এরপর [অত্যাচারী ম্যজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী নামক দুইজন তরুণ বিপ্লবীর হাতে। কিংস ফোর্ডের গাড়ী লক্ষ্য করে বােমা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ মিসেস্ কেনেডি ও মিস্ কেনেডি নামক দুজন নিরপরাধ মহিলা মারা যান। প্রফুল্ল চাকি আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়েন ও প্রাণ দন্ডে দন্ডিত হন। ক্ষুদিরামের আত্মদান বাংলার ঘরে ঘরে প্রেরণার সঞ্চার করে। শীঘ্রই পুলিশ মুরারি পুকুরের বােমার আস্তানা ঘিরে ফেলে এবং অরবিন্দ ঘােষবারিন্দ্র কুমার সহ ৩৬ জন বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে। এরপর শুরু হয় আলিপুর বােমার মামলা। নরেন্দ্র গোঁসাই নামে এক দুর্বল চিত্ত বিপ্লবী পুলিশের কাছে সকল গােপন তথ্য ফাঁস করে দেয়। কানাই লাল দত্ত এবং সত্যেন বসু নামে দুই সহযােগী বিপ্লবী নরেনকে জেলের মধ্যে গুলি করে হত্যা করেন। এদের দুজনেরই ফাঁসি হয়। এদিকে আলিপুর বােমার মামলায় ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাসের প্রচেষ্টায় অরবিন্দ ঘােষ মুক্তি পান। কিন্তু বারিন্দ্র, উল্লাস কর দত্ত প্রমুখর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দন্ড হয়। মুক্তি হয় অরবিন্দ বিপ্লবের সংস্পর্শ ত্যাগ করে আধ্যাত্ম আরাধনায় ব্রতী হলেন।
আলিপুর বােমার মামলার পর সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। বিপ্লবী সভা-সমিতির প্রতি সরকারী দমন নীতি কঠোর আকার ধারণ করে এবং ১৯০৯ খ্রীঃ কলকাতায় যুগান্তর ও অনুশীলন সমিতি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাই বলে বৈপ্লবীক প্রচেষ্টা স্তিমিত হয়ে যায় – একথা মনে করা ভুল। সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী। ১৯০৭-১৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বাংলার বিপ্লবী গণ প্রায় ৬৪ জন সরকারী কর্মচারীকে হত্যা করে। শীঘ্রই যদুগােপাল মুখােপাধ্যায়, বাঘাযতীন প্রমুখ যুগান্তর গােষ্ঠীর নেতারা বৈদেশিক শক্তির সাহায্যে সশস্ত্র বিপ্লবের পথে অগ্রসর হলেন। রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে অপর এক গােষ্ঠি সম্মুখ যুদ্ধের পন্থা গ্রহণ করে। অপর দিকে ঢাকার অনুশীলন সমিতি ডাকাতি ও গুপ্ত হত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোন বিপ্লবী গােষ্ঠিই জনগণকে সঠিকভাবে সংগঠিত করার কার্যে নজর দেয়নি। ফলে শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত না হওয়ায় বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .