অবশিল্পায়ন বলতে কী বোঝায়
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রারম্ভিক লগ্ন থেকে আর্থিক শোষণের যে নীতি গ্রহণ করা হয় তার ফলে ভারতীয় কুটিরশিল্প ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। এই ঘটনাকে অবশিল্পায়ন বলা হয়। সব্যসাচী ভট্টাচার্যের মতে, জাতীয় আয়ে কৃষিজ অবদান বৃদ্ধি ও শিল্পজাত অবদান কমে যাওয়াকে অবশিল্পায়নরূপে ব্যাখ্যা করা যায়।
অবশিল্পায়নের কারণ
অবশিল্পায়ন তত্ত্বকে অনেকেই স্বীকার করেননি। মার্কিন গবেষক মরিস ডি. মরিস বিষয়টিকে ‘কল্পকাহিনি’ মনে করেন। কিন্তু জাপানি ঐতিহাসিক তরু মাৎসুই ও ভারতীয় ঐতিহাসিক বিপানচন্দ্র সংখ্যাতত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করেছেন। রজনীপাম দত্ত, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ, অমিয় বাগচী প্রমুখ অবশিল্পায়নের বিভিন্ন কারণ চিহ্নিত করেছেন।
দাদন ব্যবস্থা
নতুন ভূমিরাজস্ব ও বাণিজ্যনীতির ফলে দরিদ্র চাষি ও তাঁতিরা অগ্রিম অর্থ বা দাদন গ্রহণ করত। ফলে দেশীয় বাজার ছেড়ে তারা কোম্পানির কাছে কম মূল্যে ঋণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হত। এর ফলে দেশীয় শিল্পে কাঁচামালের অভাব ও মূল্যবৃদ্ধি দেখা দেয়।
পৃষ্ঠপোষকতার অভাব
দেশীয় শাসকবর্গের উদ্যোগেই ভারতের কুটির শিল্প বেঁচেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসন শুরু হলে স্থানীয় শাসকদের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কুটিরশিল্পও ধ্বংস হয়।
অত্যাচার
ভারতে ব্রিটিশ বণিকদের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডের শৌখিন দ্রব্য ভারতের বাজারে প্রবেশ করানো। একাজে তাদের বাধা ছিল ভারতের দক্ষ শিল্পীদের অনন্য শিল্পসৃষ্টি। তাই এক্ষেত্রে তারা শাসকশ্রেণির সাহায্যে শিল্পীদের ওপর অত্যাচার শুরু করে। 1769 খ্রিস্টাব্দের 17 মার্চের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে শিল্পীদের বুড়ো আঙুল কেটে নেওয়া হত।
শুল্কবৈষম্য
ভারতের কুটির শিল্প যাতে ইউরোপের বাজারে ছড়াতে না পারে তার জন্য সুতিবস্ত্রের ওপর 67\tfrac{4}{2}% ও মসলিনের ওপর 37\tfrac{1}{2}% শুল্ক বসানো হয়। অপরদিকে ইংল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত বস্ত্রে মাত্র 2\tfrac{1}{2}% শুল্ক বসানো হয়।
বাণিজ্যনীতি
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার আইনে ভারতে অবাধ বাণিজ্যনীতি প্রচলিত হয়। ইংল্যান্ডের কলকারখানায় সস্তা দামের কাপড়ে বাজার ছেয়ে যায় ও ভারতীয় শিল্প পিছিয়ে পড়ে।
শিল্পবিপ্লব
ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটলে অল্প সময়ে অধিক পরিমাণে ও উন্নতমানের দ্রব্য তৈরি হয়, যার কাছে ভারতীয় শিল্প পরাজিত হয়। যে কারণে রাসব্রুক বলেছেন— ‘ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবই ভারতীয় শিল্পবাণিজ্য ধ্বংসের মূল কারণ।”
ব্রিটিশ শাসন
রমেশচন্দ্র দত্ত, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে মনে করেন, ব্রিটিশ সরকার ইংল্যান্ডের শিল্পপতিদের স্বার্থে ভারতে বাণিজ্যনীতি পরিচালনা করে। ভারতে জাতীয়তাবাদী সরকার থাকলে এ ধরনের বাণিজ্যনীতি কখনোই প্রচলন করা হত না।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .