শিল্প বিপ্লব কথার অর্থ ও বৈশিষ্ট্য
শিল্প বিপ্লব’ কথাটি এখন বহুল প্রচলিত।বিখ্যাত দার্শনিক অগাস্তে ব্ল্যাংকি ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম ‘শিল্প বিপ্লব’ কথাটি ব্যবহার করেন। তারপর ১৮৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট ইংরেজ ঐতিহাসিক টয়েনবি তাঁর অক্সফোর্ড বক্তৃতামালার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী মহল ‘শিল্প বিপ্লব’ কথাটি জনপ্রিয় করে তােলেন। শিল্প বিপ্লব বলতে কি বােঝায়, তা নিয়ে পণ্ডিতরা একমত নন। সাধারণভাবে বলা যায় যে, অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে বহু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার এবং উৎপাদনক্ষেত্রে তা প্রয়ােগের ফলে শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ ও গুণগত মানের ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন দেখা দেয়, তা শিল্প বিপ্লব নামে খ্যাত। ঐতিহাসিক ফিশার মনে করেন যে, দৈহিক শ্রমের পরিবর্তে যন্ত্রপাতির দ্বারা শিল্পসামগ্রীর উৎপাদন এবং এর ফলস্বরূপ উৎপাদন বৃদ্ধিকে ‘শিল্প বিপ্লব’ বলা হয়। অধ্যাপক ফিলিস ডীন বিষয়টিকে
একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, কেবল যন্ত্রের দ্বারা উৎপাদন হলেই শিল্প বিপ্লব হয় না—এর সঙ্গে আরও কতকগুলি আনুষঙ্গিক পরিবর্তন ঘটলে তবেই তা শিল্প
বিপ্লব হয়। এই বিষয়গুলি হল-
(১) মূলধন বিনিয়ােগের দ্বারা যন্ত্রচালিত বৃহৎ কারখানা স্থাপন,
(২) উৎপাদিত পণ্য মুনাফার ভিত্তিতে বাজারে বিক্রি করা,
(৩) উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মজুরির বিনিময়ে শ্রমিক নিয়োেগ,
(৪) উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল ও শ্রমিকের পাশাপাশি মূলধন সরবরাহের জন্য ব্যাঙ্ক বা অর্থ বিনিয়ােগকারী সংস্থার বিকাশ ঘটানেনা,
(৫) মাল পরিবহনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। এইসব ব্যবস্থার একত্র সমন্বয় ঘটলে তবেই তা শিল্প বিপ্লব হয়। ঐতিহাসিক প্লাম্ব (J. H. Plumb) বলেন যে, নব্যপ্রস্তর যুগের পর মানব-সভ্যতার অর্থনৈতিক জীবনে এত বড় পরিবর্তন আর ঘটেনি। ঐতিহাসিক সিপােল্লা বলেন যে, বিশ্ব ইতিহাসের কোন বিপ্লবই শিল্প বিপ্লবের মতাে নাটকীয় নয়।
বৈশিষ্ট্য :- শিল্প বিপ্লবের কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়।
(১) অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে বহু মানুষের সম্মিলিত চেষ্টার ফলে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ফরাসী বিপ্লব অন্য কোন বিপ্লবের মতাে এতে কোন চমক বা আকস্মিকতা নেই। তাই হ্যাজেন হেজ প্রমুখ ঐতিহাসিক শিল্প বিপ্লব’ কথাটির পরিবর্তে ‘শিল্প বিবর্তন’ কথাটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। তবে এ কথাও ঠিক যে, শিল্পক্ষেত্রের এই মন্থর পরিবর্তনটি মানুষের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে আমূল ও
সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন এনেছিল তাতে তাকে বিপ্লব বলা অযৌক্তিক নয়। অধ্যাপক বার্নি, বেয়ার্ড প্রমুখ একে বিপ্লব নামেই অভিহিত করেছেন।
(২) এই বিপ্লব সর্বত্র একই সময়ে দেখা দেয়নি। বিপ্লবের সূচনা ইংল্যান্ডে এবং পরে তা ইওরােপের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ইংল্যান্ডে এই বিপ্লবের সূচনা কবে তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। আর্নল্ড টয়েনবি-র মতে ১৭৪০-৬০ খ্রিস্টাব্দ হল শিল্প বিপ্লবের সূচনাকাল। ফিলিস ডিন এ সম্পর্কে ১৭৬০-৮০ খ্রিস্টাব্দের কথা বলেন। রােস্টো, হব প্রমুখ অধিকাংশ। ঐতিহাসিক শেষােক্ত মতটিকেই সমর্থন করেন। মার্কিন ঐতিহাসিক নেফ অবশ্য এ ধরনের কোন সুনির্দিষ্ট কালসীমা চিহ্নিতকরণের বিরােধী এবং তিনি ইতিহাসের প্রবহমানতায় বিশ্বাসী।
(৩) আগে ইওরােপের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। কুটির শিল্পের মাধ্যমে দৈহিক শ্রমের সাহায্যে শিল্পসামগ্রী উৎপাদিত হত। শিল্প বিপ্লবের ফলে উৎপাদন পদ্ধতি যন্ত্রনির্ভর ও কলকারখানা-ভিত্তিক হয়ে ওঠে। এর ফলে ইওরােপের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়।
(৪) আগে ইওরােপের অধিকাংশ লােক গ্রামে বাস করত এবং কৃষি ও পশুপালন তাদের প্রধান বৃত্তি ছিল। শিল্প বিপ্লবের ফলে মানুষ শহরমুখী হয় ও কলকারখানায় শিল্পকর্মে নিযুক্ত হয়। এর ফলে শহরকেন্দ্রিক শিল্প-সভ্যতা গড়ে ওঠে।
(৫) শিল্প বিপ্লব কৃষ্টি, বস্ত্র, কয়লা, লৌহ, পরিবহন—সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তি ও কৌশলগত বিপ্লব এনে দেয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .