আকবরের রাজপুতনীতি
মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাজপুত জাতির সঙ্গে মুঘল সম্রাট আকবরের উদার ব্যবহারকে এক উচ্চ রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের ইতিহাসে আকবর বিখ্যাত হয়ে আছেন তার রাজপুতনীতির জন্যই।
রাজপুতদের সুযােগ-সুবিধা প্রদান
দক্ষ রাজনীতিবান্ আকবর অনুভব করতে পেরেছিলেন যে, রাজপুতরাই একমাত্র শৌর্যে ও বীর্যে উত্তর ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি। তাই তিনি তাদের হৃদয় জয়ে প্রবৃত্ত হন। রাজপুতরা সেনা হিসাবেও ছিলেন চমৎকার। স্বভাবতই আকবর আফগান, তুর্কী ও মােঙ্গলদের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির জন্য রাজপুতদের নিজ দরবারে সম্মানিত সদস্য হিসাবে মনসব প্রদান করেন। এবং তাদের সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হন। তিনি উপলব্ধি করেন, রাজপুত জাতির সঙ্গে শত্রুতা হলে মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে বিপজ্জনক। Dr. Beni Prasad’র মতে, আকবর রাজপুত জাতিকে উপযুক্ত মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার নিয়ে রাজপুতজাতির অমূল্য সহযােগিতা লাভ করেন।
বৈবাহিক নীতি
স্বজাতির প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে রাজপুত জাতির শৌর্যের ও বীর্যের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তার এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য তিনি রাজপুতদের সঙ্গে বৈবাহিক নীতি গ্রহণ করেন। আর বিহারীমলকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দান করেন। নিজপুত্র সেলিমের সঙ্গে ভগবানদাসের কন্যার বিবাহ দিয়ে মধ্যযুগের ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের এবং নতুন যুগের সূচনা করেন।
১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাৎসরিক এক কোটি টাকা আয়ের হিন্দু তীর্থযাত্রী কর এবং ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে “জিজিয়া কর’ রহিত করা হয়। যুদ্ধবন্দী হিসাবে ক্রীতদাস করার নীতি নিষিদ্ধ করেন, রাজ্যের রাজপুতপ্রধানকে মুঘল হারেমে বিবাহযােগ্য কন্যার প্রেরণ করাকে নিষিদ্ধ করেন, নওরােজ উৎসবে কোনাে রাজপুত প্রধানের স্ত্রী বা কন্যাকে উপস্থিত থাকার রীতি তুলে দেন। দেওয়ানিয়ামে রাজপুতদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই প্রবেশ করার অনুমতি দেন, রাজপুতদের ঘােড়াগুলিকে ‘দাগ’ চিহ্নিত করা থেকে অব্যাহতি দেন। রাজপুত রাজ্যগুলির সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক জীবনে হস্তক্ষেপ করা থেকে আকবর বিরত হন। এর ফলে রাজপুতরা আকবরের শাসনকে ভারতীয় শাসনকে ভারতীয় শাসন বলে মনে করে মুঘলসাম্রাজ্যের নিরাপত্তা রক্ষার ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাদের হৃদয় জয় করার উদ্দেশ্যে তিনি সংস্কৃত ভাষার উৎকর্ষের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন, হিন্দুপন্ডিতদের সমাদর করেন। হিন্দুধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের আলােচনা তিনি ইবাদত খাড়নায় সাগ্রহে শ্রবণ করতেন। বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ নীতির বিরােধীতা করেন। মধ্যযুগে তার এই নীতির সূত্র ধরেই পরধর্ম সহিষুতার দৃষ্টান্ত ভারতে স্থাপিত হয়।
কূটনীতি
আকবর রাজপুতদের ক্ষেত্রে অস্ত্র ও মৈত্রী নীতি একসাথে গ্রহণ করায় তার কূটনীতিকে ‘a master stroke of diplomacy’ বলে অভিহিত করা হয়। যতদূর সম্ভব অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে রাজপুতানায় তিনি তার শক্তি প্রয়ােগের নীতি নেন। মেবারের ক্ষেত্রেই তাঁকে অস্ত্রধারণ করতে হয়, কারণ প্রতাপসিংহ আকবরের মৈত্রী প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
মূল্যায়ন
রাজপুতদের প্রতি আকবরের উদার আচরণের ফলে ভারতে সংখ্যালঘিঃ) সমগ্র হিন্দুজাতি আকবরের শাসনকে বিদেশি শাসন বলে মনে করেননি, তিনি ‘জাতীয় নরপতি’তে পরিণত হন। এর ফলে মুঘলসাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল সুদৃঢ় ও শতাধিক বছরের জন্য স্থায়ী হয়েছিল।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .