গুজরাটের বিভিন্ন শিল্পের বিবরণ
বর্তমানে গুজরাট রাজ্য ভারতের এক অন্যতম শিল্প-সমৃদ্ধ রাজ্য: বস্তুবয়ন শিল্প; কস্টিক সোডা এবং সোডা অ্যাশ জাতীয় গুরু রাসায়নিক শিল্প; লবণ শিল্প; পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প, ঔষধ ও তৎসম্পর্কীয় রাসায়নিক শিল্প, ধাতব ছাঁচ (ডাইস), ইলেকট্রনিক ও বৈদ্যুতিক দ্রব্য, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, মেসিন টুলস্, সিমেন্ট, রাসায়নিক সার, চিনি, দুগ্ধ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ প্রভৃতি এই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প।
■ [১] বস্ত্ৰবয়ন শিল্প
আমেদাবাদ শিল্পাঞ্চল (ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার): গুজরাট রাজ্যের বস্ত্র শিল্প প্রধানত আমেদাবাদ শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এই শহরের চারপাশে একসঙ্গে ভারতের সর্বাধিক প্রায় ৭২টি সুতা এবং কাপড়ের কল গড়ে উঠেছে। ইংল্যান্ডের ম্যাঞ্চেস্টার শহরের মতো এই শহরে একসঙ্গে এত বেশি সংখ্যায় কাপড় কল গড়ে ওঠায় আমেদাবাদকে “ভারতের ম্যাঞ্চেস্টার” বলা হয়।
আমেদাবাদে বস্ত্রশিল্প কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণ
(১) সুলভ কাঁচামাল: গুজরাটের কৃষ্ণমৃত্তিকা অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী তুলা উৎপাদক অঞ্চলের উৎকৃষ্ট তুলার সুপ্রচুর যোগান; (২) সুলভ শক্তি সম্পদ : পার্শ্ববর্তী এলাকার সুলভ জলবিদ্যুৎ; (৩) সুলভ মূলধন : গুজরাটের ধনী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের যথেষ্ট মূলধন বিনিয়োগ; (৪) সুলভ শ্রম সম্পদ : নিকটবর্তী রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং সুরাট অঞ্চলের স্থানীয় দক্ষ শ্রমিকের সুপ্রচুর সরবরাহ, (৫) বন্দরের নৈকট্য : মুম্বই, কাণ্ডালা প্রভৃতি বন্দরের নৈকট্য আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের সহায়ক হয়েছে; (৬) উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা : আমেদাবাদ শহরটি সড়ক ও রেলপথে ভারতের বিভিন্ন স্থানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় কাঁচা তুলা আনা এবং আমেদাবাদে উৎপাদিত বস্ত্র বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে সুবিধে হয়; (৭) সুপ্রচুর চাহিদা : দেশে ও বিদেশে আমেদাবাদের কাপড় কলে তৈরি উৎকৃষ্ট বস্ত্রের বিপুল চাহিদা এই অঞ্চলে বস্ত্র বয়ন শিল্প গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
→ আমেদাবাদ ছাড়া এই রাজ্যের সুরাট, ব্রোচ এবং বরোদা অঞ্চলে কয়েকটি কাপড় কল আছে।
■ [২] সোডা অ্যাশ শিল্প
গুজরাটে তিনটি সোডা অ্যাশ তৈরির বড়ো কারখানা (টাটা কেমিক্যালস্, ডি.ও.সি.এল. ও সৌরাষ্ট্র কেমিক্যালস্) আছে। ভারতের মোট উৎপন্ন সোডা অ্যাশের প্রায় ৯৭% সোডা অ্যাশ এই তিনটি কারখানায় উৎপন্ন হয়।
■ [৩] লবণ শিল্প
গুজরাট ভারতের অন্যতম প্রধান লবণ উৎপাদক রাজ্য। প্রধানত ছোটো রণ ও ভুজ অঞ্চলে সমুদ্রের জল থেকে এখানে ভারতের প্রায় ৬৫% লবণ উৎপন্ন হয়।
■ [৪] পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প
গুজরাট বর্তমানে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি করেছে। এই রাজ্যের আলিয়াবেত, আঙ্কলেশ্বর, কালোল, কাম্বে প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রচুর খনিজ তৈল উৎপাদন এই রাজ্যে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের উন্নতিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বরোদার কাছে ভারতের বৃহত্তম পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্সটি অবস্থিত। ইণ্ডিয়ান পেট্রোকেমিক্যাল কর্পোরেশনের দ্বারা নির্মিত অলিফিন কমপ্লেক্স এই অঞ্চলে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের উন্নতির একটা বড়ো উদাহরণ। এখানে বছরে প্রায় ৭৩ লক্ষ মেট্রিক টন খনিজ তৈল পরিশোধিত হতে পারে। এই রাজ্যের “কয়লীতে তৈল পরিশোধনাগার স্থাপন এ অঞ্চলে শিল্পের উন্নতির যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। রিলায়েন্স গ্রুপের উদ্যোগে এই রাজ্যের হাজিরা ও জামনগরে এবং ইন্ডিয়ান পেট্রোকেমিক্যাল কর্পোরেশনের উদ্যোগে দাহেজ-এ পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স গড়ে উঠেছে।
• পেট্রো-রসায়ন শিল্পে গুজরাটের উন্নতির কারণ
গুজরাট রাজ্য বর্তমানে পেট্রো-রসায়ন শিল্পে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেছে, যেমন :
(১) স্বাধীনতার পর গুজরাট রাজ্যের ক্যাম্বে, আঙ্কলেশ্বর, কালোল, কয়ালি, আলিয়াবেত প্রভৃতি স্থানে নতুন নতুন তৈলখনি আবিষ্কার এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রচুর খনিজ তেল উৎপাদন হল এই রাজ্যের পেট্রো-রসায়ন শিল্পে উন্নতির প্রধান কারণ;
(২) এই রাজ্যের কয়ালিতে ভারতের বৃহত্তম তৈলশোধনাগার স্থাপন এই রাজ্যের পেট্রোরসায়ন শিল্পের উন্নতিতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে;
(৩) এই রাজ্যের উৎপাদিত খনিজ তেল থেকে যেসব বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য পাওয়া যায় তা এই রাজ্যের পেট্রো-রসায়ন শিল্পের দ্রুত উন্নতির সহায়ক হয়েছে, যেমন : খনিজ তৈল শোধনাগারের অন্যতম উপজাত দ্রব্য ন্যাপথার ওপর ভিত্তি করে গুজরাট পেট্রোরসায়ন শিল্পে অসাধারণ উন্নতি করেছে।
অপরিশোধিত খনিজ তৈলের অন্যতম উপজাত দ্রব্য ন্যাপথার সাহায্যে গুজরাটের ভাদোদরা, হাজিরা, দাহেজ, জামনগর প্রভৃতি স্থানে নানানরকম পেট্রোরসায়ন শিল্প গড়ে উঠেছে, যেমন : পলিমার, প্লাস্কি ও প্লাস্টিকজাত বিভিন্ন শিল্পদ্রব্য (যেমন : পাইপ, জলের ট্যাঙ্ক, চেয়ার, টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র), কৃত্রিম রবার, ফোম, টায়ার, জুতো, পি.ভি.সি., পলিয়েস্টার তত্ত্ব, ভিটামিন ‘এ’ ওষুধ, ক্রিম, সুগন্ধি দ্রব্য ও প্রসাধন সামগ্রী, ডিটারজেন্ট, রং, রাসায়নিক আঠা, রাসায়নিক সার, গন্ধক, কীটনাশক ওষুধ প্রভৃতি;
এছাড়া, (৪) গুজরাট রাজ্যের উপযুক্ত পরিকাঠামোগত সুবিধা; (৫) মুম্বই ও কান্ডালা বন্দরের নৈকট্য; (৬) এই রাজ্যের উকাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ৭/৮টি বৃহদায়তন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, কাকড়াপাড়া ও কোটা (রাজস্থান) পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপন্ন সুলভ বিদ্যুৎ; (৭) বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয় মূলধনের যোগান; (৮) গুজরাট রাজ্যের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পোদ্যোগী এবং (৯) এই রাজ্যের কর্মদক্ষ রাজ্য প্রশাসনের জন্যও এই রাজা পেট্রো-রসায়ন শিল্পে দ্রুত উন্নতি লাভ করেছে।
■ [৫] রাসায়নিক সার ও গুরু রাসায়নিক শিল্প
এই রাজ্যের কালোল, কাণ্ডালা বৃহদায়তন সারকারখানা আছে সুরাট জেলার “হাজিরা”-তে ফার্টিলাইজার কমপ্লেক্স নির্মিত হচ্ছে। দ্বারকার নিকটবর্তী মিঠাপুর অঞ্চলে সোডা অ্যাশ, হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড, ব্লিচিং পাউডার তৈরির গুরু রাসায়নিক শিল্পকেন্দ্র অবস্থিত। এছাড়া এই রাজ্যের কয়ালি তৈলশোধনাগারের ওপর নির্ভর করে বরোদায় রাসায়নিক শিল্প গড়ে উঠেছে।
■ [৬] সিমেন্ট শিল্প
জামনগর, কাম্বে, সিক্কা, সেওয়ালিয়া, পোরবন্দর, দ্বারকা প্রভৃতি অঞ্চল হল গুজরাটের প্রধান সিমেন্ট উৎপাদক কেন্দ্র।
■ [৭] দুগ্ধ (ডেয়ারী) প্রকল্প
বর্তমানে দুগ্ধ শিল্পে গুজরাট অসাধারণ উন্নতি করেছে। সারা ভারতে মোট উৎপন্ন প্রায় ৬৩% বেবিফুড এবং ৪৭% মিল্ক পাউডার এই রাজ্যে উৎপাদিত হয়। হিম্মতনগর, আনন্দ, মহসেনা, রাজকোট, সুরাট, জুনাগড়, ভবনগর, জামনগর, আমেদাবাদ প্রভৃতি হল গুজরাটের উল্লেখযোগ্য দোহ শিল্পকেন্দ্র। গুজরাটে প্রধানত সমবায় ব্যবস্থাপনায় দুগ্ধ শিল্প প্রসার লাভ করেছে। এই রাজ্যের সবরকাথা জেলার আনন্দ ও হিম্মতনগরে ভারতের বৃহত্তম দুগ্ধ উৎপাদন সংস্থা (আমূল) অবস্থিত। এছাড়া মহেসনার দুধসাগর এবং সুরাটের সুমুল হল ভারতের অন্যতম সমবায় দুগ্ধ প্রতিষ্ঠান।
• দুগ্ধজাত শিল্পে গুজরাটের উন্নতির কারণ :
(১) গুজরাটের ভূপ্রকৃতি প্রধানত সমতল। এছাড়া এই রাজ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেশ কম। যদিও গুজরাটের দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের কিছু অংশ জলসেচের সাহায্যে কৃষিতে উন্নতি লাভ করেছে, কিন্তু এই রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিমের বিস্তীর্ণ অংশে বৃষ্টি বেশ কম এবং সেচের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই উত্তর ও পশ্চিম গুজরাটের বন্ধুর ভূভাগ, অনুর্বর ও অগভীর মৃত্তিকা এবং লবণাক্ত জলাভূমির জন্য এই অঞ্চলের সর্বত্র কৃষিকাজ করা যায় না। কিন্তু তৃণভূমি সৃষ্টির আদর্শ প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য উত্তর-পশ্চিম গুজরাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সৃষ্টি হওয়া বিরাট তৃণভূমি অঞ্চলে স্বাভাবিক ভাবেই পশুপালন ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করেছে। এই অঞ্চলে প্রতিপালিত পশুর মধ্যে গোরু ও মোষের সংখ্যাই বেশি। বিশেষ করে ভবনগর, আশ্রেলী, সুরেন্দ্রনগর, সবরকাথা প্রভৃতি অপেক্ষাকৃত শুষ্ক অঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উন্নত জাতের অসংখ্য গোরু, মোষ প্রভৃতি দুগ্ধ-প্রদায়ী পশু পালন করা হয়। এই বিপুল সংখ্যক দুগ্ধপ্রদায়ী গোরু ও মোষের ওপর নির্ভর করে গুজরাট রাজ্য দোহশিল্প উন্নতি লাভ করেছে।
(২) দুগ্ধ শিল্পে সমবায় প্রথা প্রবর্তন (আনন্দের আমূল, মহেসনার দুধসাগর এবং গুজরাটের সুমুল হল ভারতের অন্যতম সমবায় দুগ্ধ প্রতিষ্ঠান) এবং
(৩) উন্নত বিপণন ব্যবস্থা এই রাজ্যের দুগ্ধ শিল্পের উন্নতির অন্যতম প্রধান কারণ। জাহাজ নির্মাণ শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করছে।
■ [৮] জাহাজ নির্মাণ শিল্প
বর্তমানে এই রাজ্যের ভবনগরের কাছে অবস্থিত “আলং”নামক স্থানে
■ [৯] ইলেকট্রনিক এবং বৈদ্যুতিক দ্রব্য নির্মাণ শিল্প
বর্তমানে এই রাজ্যের গান্ধিনগরের কাছে স্থাপিত ইলেকট্রনিকস কমপ্লেক্স স্থাপনের কাজ দ্রুত সমাপ্তির পথে। এখানে প্রায় ১৫০ টির বেশি ছোট বৈদ্যুতিক শিল্প কেন্দ্র ছাড়াও বহু বড়ো এবং মাঝারি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া গান্ধিনগরে সরকারি সংস্থা “গুজরাট কমিউনিকেশন এন্ড ইলেকট্রনিকস্ লিমিটেড” (GCEL)- এর বড়ো কারখানা আছে।
■ [১০] লৌহ-ইস্পাত শিল্প
সম্প্রতি এসার গ্রুপের উদ্যোগে এই রাজ্যের হাজিরার কাছে লৌহ-ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠেছে।
গুজরাটের উল্লেখযোগ্য শিল্প ও শিল্প কেন্দ্র
উল্লেখযোগ্য শিল্প | শিল্প কেন্দ্র |
---|---|
(১) খনিজ তৈল শোধন | কয়ালি |
(২) পেট্রোরসায়ন | বরোদা, হাজিরা, জামনগর, দাহেজ |
(৩) বস্ত্ৰবয়ন | আমেদাবাদ, সুরাট, বরোদা, ব্রোচ, রাজকোট, ভবনগর |
(৪) দুগ্ধজাত শিল্প | আনন্দ, মহেসনা, সুরটি, জুনাগড়, ভবনগর |
(৫) রেশম বয়ন | সুরাট, ভবনগর, জামনগর, আম্রোলি |
(৬) রাসায়নিক শিল্প | মিঠাপুর, আমেদাবাদ, বরোদা, ভবনগর, রাজকোট, জামনগর |
(৭) রাসায়নিক সার | কালোল, কান্ডালা |
(৮) সিমেন্ট | ভেরাবল, পোরবন্দর, দ্বারকা, ভবনগর, সেভালি |
(৯) ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প | আমেদাবাদ, বরোদা, সুরাট ভবনগর, রাজকোট |
(১০) লবণ | ওখা, পোরবন্দর, সিক্কা, মনদা |
(১১) চিনি | রাজকোট, জুনাগড়, জামনগর। |
(১২) কাগজ | আমেদাবাদ, সুরাট, খারকি, ভাগী। |
[maxbutton id=”1″ text=”Download Note PDF” url=”https://sub2unlock.xyz/21ca” linktitle=”tooltip” window=”new” nofollow=”true”]
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .