হুগলি শিল্পাঞ্চলটি স্বাধীনতার আগে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিল। স্বাধীনতার পর থেকেই এই শিল্পাঞ্চলের উৎপাদন ব্যবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ৬০-এর দশকের প্রথম থেকে নানান কারণে বহু কারখানার উৎপাদন খুবই কমে যায় এবং অনেক কলকারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানেও এই শিল্পাঞ্চলের উৎপাদন হারের অবনতি দেখা যাচ্ছে।
হুগলি শিল্পাঞ্চলের ক্রমাবনতির কারণ
হুগলি শিল্পাঞ্চলে সমস্যার কারণগুলো হল :
(১) প্রধান শিল্পটির সমস্যা
হুগলি শিল্পাঞ্চল এক সময়ের সর্বপ্রধান শিল্প, পাট শিল্পের গুরুত্ব ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর ভারতের মূল পাট উৎপাদক অঞ্চল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) কাঁচা পাটের অভাবে হুগলি শিল্পাঞ্চলের পাঠ শিল্পে সংকট দেখা দেয়। পরে পশ্চিমবঙ্গে পাট উৎপাদক নতুন অঞ্চল সৃষ্টি করে কাঁচা পাটের সমস্যা দূর করা হলেও গুণগত বিচারে বাংলাদেশের পাট অনেক উৎকৃষ্ট। এছাড়া বর্তমানে পাটের নানানরকম পরিবর্ত-সামগ্রী আবিষ্কৃত হওয়ায় পাটজাত দ্রব্যের চাহিদা আগের তুলনায় কমে গেছে। এর সঙ্গে রয়েছে পাটকল মালিকদের এই শিল্পের উন্নতি ও আধুনিকীকরণের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলা। এসব সমস্যায় হুগলি শিল্পাঞ্চলের সর্বপ্রধান শিল্পটির গুরুত্ব ক্রমশ কমে যাচ্ছে।
(২) সেকেলে উৎপাদিত দ্রব্য
একদা ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পাঞ্চলটি যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি। হুগলি শিল্পাঞ্চলের শিল্পগুলোতে কৃষিনির্ভর পাট ছাড়া প্রধানত সেকেলে ধরনের ভারি যন্ত্রশিল্প, মামুলি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প, রাসায়নিক শিল্প, কাগজ ও বস্ত্র শিল্পের আধিক্য দেখা যায়, যারা সাধারণভাবে ‘অস্তাচলের শিল্প’ বলে পরিচিত। যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই সমস্ত শিল্পসামগ্রীর চাহিদা ও সম্ভাবনাও কমে এসেছে। বর্তমানে এইসব শিল্পের স্থান দখল করে নিয়েছে প্রধানত ইলেকট্রনিক্স ও কম্পিউটার-নির্ভর আধুনিক শিল্পসমূহ, যাদের ‘উদয়াচলের শিল্প’ বলা হয়। এইসব আধুনিক শিল্পসামগ্রী উৎপাদনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান হুগলি শিল্পাঞ্চলে খুবই কম।
(৩) হুগলি নদীর নাব্যতা হ্রাস ও কলকাতা বন্দরের সমস্যা
হুগলি নদী মজে আসার দরুন, কলকাতা বন্দরে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদিত দ্রব্য বিদেশে পাঠাবার উপযুক্ত বড়ো বড়ো জাহাজের প্রবেশের অসুবিধা হয়। এই জন্য কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির পরিমাণও যথেষ্ট কমেছে। এই শিল্পাঞ্চলের বৈদেশিক বাজার আজ অনেকটাই হাতছাড়া।
(৪) প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎশক্তির অভাব
শক্তির, বিশেষত বিদ্যুৎশক্তির অভাবে আধুনিক কলকারখানা চালানোর অসুবিধা হয়।
(৫) স্থান সংকট ও জমির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি
অত্যধিক জনবসতির চাপে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠার উপযুক্ত স্থানের অভাব এবং শিল্পস্থাপনের উপযুক্ত জমির অসম্ভব মূল্যবৃদ্ধি হুগলি শিল্পাঞ্চলের শিল্পবিকাশের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
(৬) অসম মূলধন বিনিয়োগ
স্বাধীনতার পর ফরিদাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, দিল্লি, মুম্বই প্রভৃতি শহরসহ গুজরাট, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা প্রভৃতি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে শিল্পোন্নয়নের জন্য বিভিন্ন শিল্পপতি, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করা হলেও তৎকালীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই শিল্পাঞ্চলটিতে মূলধন বিনিয়োগের ওপর বিশেষ কোনো নজর দেওয়া হয় নি, বরং এই শিল্পাঞ্চল থেকে অর্জিত মুনাফা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ফলে মূলধনের অভাবে এই শিল্পের নাভিশ্বাস উঠেছে।
(৭) উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব
বেশ কয়েকটি দশক ধরেই হুগলি শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে রাস্তা, বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ ভূতি পরিকাঠামোর উন্নতির দিকে বিশেষ কোনো নজর দেওয়া হয়নি। যে কোন শিল্পের পক্ষেই বিশেষ প্রয়োজনীয় এইসব সুযোগ-সুবিধার অভাব এই অঞ্চলে শিল্পপতি ও অর্থলগ্নী প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন মূলধন বিনিয়োগের অনীহাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
(৮) শ্রমিক সমস্যা
শ্রমিক অসহযোগিতা ও কর্মসংস্কৃতির অভাব প্রভৃতি কারণে হুগলি শিল্পাঞ্চলে মন্দার ভাব দেখা দিয়েছে।
ওপরের ৮টি প্রধান কারণ ছাড়াও : (৯) শিল্প পরিচলন ব্যবস্থার ত্রুটি, (১০) কেন্দ্রীয় সরকারের অসম লাইসেন্স নীতি, (১১) কলকারখানাগুলোর পুরোনো যন্ত্রপাতি ও আধুনিকীকরণের অভাব, (১২) কর্মী ছাঁটাই, ঘেরাও, লক আউট প্রভৃতি কারণে উৎপাদন কমে যাওয়া, (১৩) রাজ্য সরকারের অদূরদর্শিতা প্রভৃতি কারণও হুগলি শিল্পাঞ্চলের বর্তমানের অবনতির জন্য দায়ী।
হুগলি শিল্পাঞ্চলের সমস্যা সমাধান ও সম্ভাবনা
হুগলি শিল্পাঞ্চলের এই সমস্ত সমস্যাগুলো দূর করে এর হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য সরকারী উদ্যোগে নানানরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, যেমন :
(১) হুগলি নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির চেষ্টা
ফারাক্কা ব্যারেজ মারফৎ অতিরিক্ত জলের যোগান দিয়ে কলিকাতা বন্দর এলাকায় হুগলি নদীর পলি অপসারণের চেষ্টা করছেন।
(২) হলদিয়া বন্দর স্থাপন
বড়ো বড়ো জাহাজ আনাগোনায় সাহায্য করার জন্য কলকাতার সাহায্যকারী হলদিয়া বন্দর হলদিয়াতে স্থাপিত হয়েছে।
(৩) নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা
বিদ্যুতের সুলভ সরবরাহের জন্য কোলাঘাট, ফারাক্কা, সাঁওতালডিহি প্রভৃতি স্থানে তাপবিদ্যুৎ কারখানা স্থাপিত হয়েছে।
(৪) আধুনিক শিল্পস্থাপনে উৎসাহ প্রদান
বর্তমানে এই অঞ্চলে আধুনিক শিল্পস্থাপনের জন্য শিল্পপতিদের সরকার থেকে নানাভাবে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে হুগলি শিল্পাঞ্চলের সল্টলেক অঞ্চলে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স’ গড়ে তোলা হয়েছে।
(৫) বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ
শুধুমাত্র দেশীয় শিল্পপতিদের ওপর নির্ভর না করে এই শিল্পাঞ্চলে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ যাতে বাড়ে সে চেষ্টাও করা হচ্ছে। এছাড়া বক্রেশ্বর, মেজিয়া প্রভৃতি স্থানে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনেরও প্রচেষ্টা চলেছে।
(৬) বর্তমানে পাট শিল্পের (হুগলি শিল্পাঞ্চলের প্রধান শিল্প) উন্নতির জন্য সরকারি উদ্যোগে নানারকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং
(৭) উন্নয়নমূলক কাজের মাধ্যমে হুগলি শিল্পাঞ্চলের পরিকাঠামোর সামগ্রিক উন্নতির চেষ্টা
হুগলি শিল্পাঞ্চলের সামগ্রিক পরিকাঠামোর উন্নতির জন্য প্রধানত সরকারি সংস্থা সি. এম. ডি. এ-র তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
(৮) ভারত সরকারের উদারনীতি
ভারত সরকারের বর্তমান উদার শিল্পনীতি, মাসুল সমীকরণ নীতির বর্জন, লাইসেন্স প্রথার অবলুপ্তি প্রভৃতি হুগলি শিল্পাঞ্চলে শিল্পগঠনে সহায়ক হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
আশা করা যাচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতে হুগলি শিল্পাঞ্চল সমস্ত সমস্যাগুলি কাটিয়ে উঠে আবার পূর্ব গৌরব ফিরে পাবে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .