হুগলি শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার কারণ
ভারতের প্রাচীনতম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্পাঞ্চল, হুগলি শিল্পাঞ্চলটি নিম্নগাঙ্গেয় সমভূমির দক্ষিণ অংশে হুগলি নদীর দু’পাশ জুড়ে বিস্তার লাভ করেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাসহ হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা এবং নদীয়া জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত এই শিল্পাঞ্চলটি হুগলি নদীর বাঁ তীরে, উত্তরে কল্যাণী থেকে দক্ষিণে বিড়লাপুর এবং হুগলি নদীর ডানতীরে উত্তরে ত্রিবেণী থেকে দক্ষিণে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এই শিল্পাঞ্চলটি লম্বায় প্রায় ১০০ কিমি এবং চওড়ায় প্রায় ৬-৭ কিমি স্থান জুড়ে গঠিত হয়েছে। কলকাতা মহানগরী এই বিখ্যাত শিল্পাঞ্চলের কেন্দ্রবিন্দু। হুগলি শিল্পাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য শিল্পগুলো হল পাট, ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার, কাগজ, কার্পাস বয়ন, অ্যালুমিনিয়াম, চামড়া, টায়ার, ইলেকট্রনিক ও রাসায়নিক শিল্প।
হুগলি শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার কারণগুলো হল :
■ [ক] ঐতিহাসিক কারণ
শিল্পোন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে কলকাতা বৃটিশ ভারতের রাজধানী থাকায় এই অঞ্চলে শিল্প স্থাপনে অর্থ বিনিয়োগ করতে ধনী ব্রিটিশ শিল্পপতিরা উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাই প্রধানত ব্রিটিশ মূলধন বিনিয়োগের ফলে ঊনবিংশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে হুগলি নদীর উভয় তীরেই ভারতের প্রথম আধুনিক শিল্পাঞ্চলের গোড়াপত্তন হয়।
■ [খ] ভৌগোলিক কারণ :
(১) কাঁচামাল পাওয়ার সুবিধা
প্রাক্-স্বাধীনতার যুগে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অংশে উৎপাদিত উৎকৃষ্ট পাটসহ ভারতের পূর্বাঞ্চলে উৎপন্ন পাট নদীপথে আনার সুবিধা থাকার ফলে এই শিল্পাঞ্চলে পাট শিল্প একচেটিয়াভাবে গড়ে উঠেছিল। বর্তমানেও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশে উৎপাদিত পাট ও মেস্তা এবং অন্যান্য শিল্পের প্রয়োজনীয় প্রায় সব রকম কাঁচামাল পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও বিহার থেকে পাওয়া যায়। এছাড়া হুগলি নদীর অফুরন্ত জল ভাণ্ডার এই অঞ্চলের শিল্পে জলের চাহিদা মেটায়।
(২) উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
হুগলি শিল্পাঞ্চলটি সমতলভূমিতে অবস্থিত হওয়ার জন্য এখানে সড়ক ও রেলপথে পরিবহনের বিশেষ সুবিধা রয়েছে। এই অঞ্চলটি পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথ, এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়ক (২, ৫, ৬, ও ৪১ নং জাতীয় সড়ক) ও রাজ্য সড়কের মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ায় নানা জায়গা থেকে কাঁচামাল আনা ও উৎপাদিত সামগ্রী বিভিন্ন স্থানে পরিবহনের বিশেষ সুবিধা থাকায় শিল্প স্থাপনের সহায়ক হয়েছে। এছাড়া হুগলি নদীর মাধ্যমে জলপথেও অতি সহজে পণ্য পরিবহন
(৩) শক্তি সম্পদের সহজলভ্যতা
নিকটবর্তী রানিগঞ্জ অঞ্চলের কয়লার সুলভ সরবরাহ এই শিল্পাঞ্চলের শক্তিসম্পদের চাহিদা মিটিয়েছে। আবার কয়লা থেকেই মূলাজোড়, কাশীপুর, টিটাগড়, কোলাঘাট, সাঁওতালডিহি, ব্যাণ্ডেল প্রভৃতি কেন্দ্রে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় এবং শিল্প-কারখানার প্রয়োজন মেটায়। এছাড়া ডি.ভি.সি-র বিভিন্ন প্রকল্পের জলবিদ্যুৎও হুগলি শিল্পাঞ্চলে ব্যবহার করা হয়।
(8) কলকাতা বন্দরের নৈকট্য
বিখ্যাত বন্দর কলকাতার অবস্থানের জন্য শিল্প-কারখানার উপযোগী কাঁচামাল আমদনির এবং উৎপাদিত দ্রব্য বিদেশে রপ্তানির বিশেষ সুবিধা রয়েছে।
(৫) বাজারের চাহিদা
এই ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে শিল্পজাত দ্রব্যের প্রচুর চাহিদা থাকায় স্থানীয় বিশাল বাজারের চাহিদা পূরণের জন্য এখানে বস্ত্র, রাসায়নিক প্রভৃতি শিল্প গড়ে উঠেছে।
(৬) সুলভ দক্ষ শ্রমিক
কলকাতা ও তার আশপাশের অঞ্চলে দক্ষ শ্রমিকের সরবরাহ অত্যন্ত সুলভ থাকায় শিল্পের
চাহিদা পূরণ সহজ হয়েছে এবং শিল্প-কারখানা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(৭) সুলভ অদক্ষ শ্রমিক
ঝাড়খণ্ড, বিহার, ওড়িশা প্রভৃতি অঞ্চল থেকে অদক্ষ শ্রমিকের সুলভ সরবরাহ থাকায় শিল্প স্থাপন সহজ হয়েছে।
(৮) হুগলি নদীর সুলভ জলসম্পদ
হুগলি নদী থেকে সহজেই শিল্পের প্রয়োজনীয় জল সংগৃহীত হয়েছে এবং শিল্পের অপ্রয়োজনীয় আবর্জনা হুগলি নদীতে নিক্ষেপিত ও বাহিত হয়েছে।
(৯) আর্দ্র আবহাওয়া
নদীতীরে অবস্থানের জন্য এখানকার আর্দ্র আবহাওয়া পাট ও কার্পাস শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার সহায়ক হয়েছে।
(১০) মূলধনের জোগান
হুগলি শিল্পাঞ্চল গড়ে ওঠার প্রথম দিকে ব্রিটিশ শিল্পপতিগণ উদ্যোগী হলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক এবং বাঙালি, মারোয়াড়ি, গুজরাটি প্রভৃতি দেশীয় শিল্পপতিদের বিনিয়োগ করা পুঁজি এই অঞ্চলে শিল্পস্থাপনে বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .