রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলের মতে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ১৯০০ সালের পূর্ব পর্যন্ত যে আইন কাঠামোকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত ছিল, তা সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি নামে পরিচিত। বিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন, দর্শন ও প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির আবির্ভাব ঘটে, যা আচরণবাদ নামে পরিচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ছয়ের দশকে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড ইস্টন, রবার্ট ডাল প্রমুখের রচনায় আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির চরম বিকাশ ঘটে। আরনল্ড ব্রেখটের মতে, আচরণবাদ হল রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে একটি অভিজ্ঞতাবাদী চিরন্তন মতবাদ গড়ে তোলার প্রচেষ্টাবিশেষ। রবার্ট ডালের অভিমত অনুযায়ী, আচরণবাদ ব্যক্তির পর্যবেক্ষিত আচার-আচরণের মাধ্যমে রাজনীতির ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে। ডেভিড ইস্টনের মতে, আচরণবাদী বিশ্লেষণ মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ হওয়া প্রয়োজন।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি আলোচনা-পদ্ধতিগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক পদ্ধতি অন্যতম। অধ্যাপক অ্যালান বলের মতে, ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে সংগৃহীত তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে অতীত ঘটনাবলির বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমকালীন রাজনৈতিক ঘটনাবলীর ব্যাপারে পরীক্ষাসাপেক্ষে সিদ্ধান্তগ্রহণের কথা বলা হয়। এই পদ্ধতি বর্ণনাত্মক। এজন্য উপাদান হিসেবে রাষ্ট্রনেতাদের জীবনী ও স্মৃতিকথা, সাংবাদিকদের বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা মহাফেজখানায় সংরক্ষিত তথ্য, চিঠি-দিনলিপি-বক্তৃতা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ফ্রেডারিক পোলকের মতে, ঐতিহাসিক পদ্ধতির লক্ষ্য হল প্রতিষ্ঠানের চরিত্র কী, তাদের গতি কোন দিকে, তাদের অবস্থা কি ছিল, কী করে তারা বর্তমান অবস্থায় পৌছানো এসবের ব্যাখ্যা—তারা যে অবস্থায় আছে তার বিশ্লেষণ নয়। ঐতিহাসিক পদ্ধতির দৃষ্টান্ত স্বরূপ আইভর জেনিংসের ব্রিটিশ সংসদীয় ক্যাবিনেট সম্পর্কিত আলোচনা প্রধানমন্ত্রী পক্ষের ক্রমবিকাশ এবং রবার্ট ম্যাকেঞ্জির ব্রিটিশ রাজনৈতিক দল ও কে.পি ম্যাকিনটসের ব্রিটিশ ক্যাবিনেট ব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণা উল্লেখযোগ্য। কার্ল মার্কস ও হেগেল ইতিহাসের বস্তুবাদী ও ভাববাদী ব্যাখ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে নতুন ধারার জন্ম দিয়েছেন।
আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সনাতন বা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য
সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্যগুলি হল—
১) রাজনীতির পর্যালোচনায় সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির কাঠামো মূলত প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক ও বর্ণনাত্মক আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ফলে সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণ বিজ্ঞানসম্মত হয় না। অন্যদিকে, আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণের পক্ষপাতী।
২) পরম্পরাগত বা সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি কয়েকটি বিশিষ্ট রাজনৈতিক কাঠামোর আলোচনাকে উপেক্ষা করেছে। সেগুলি হল রাজনৈতিক দল, চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, ভোট সম্পর্কিত ব্যবহার, জনমত, রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রভৃতি । কিন্তু আচরণবাদ বিশ্বাস করে যে, ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণ অন্যান্য বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, কারণ রাজনৈতিক আচরণ হল ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, সমাজ ও সামাজিক সংগঠনের প্রকাশ। তাই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণের সঙ্গে সমাজ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোচনা করতে চায়।
৩) আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ক্ষমতা প্রয়োগের সঙ্গে যে-কোনো কাজকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয় হিসাবে মনে করে। কিন্তু সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর আচরণের পরিবর্তে রাজনৈতিক আদর্শ এবং প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রধান বিষয় হিসাবে গণ্য করে।
৪) আচরণবাদ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানগুলির মধ্যে সহযোগিতা স্থাপনে আগ্রহী। কিন্তু সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে শুধুমাত্র ইতিহাসের ওপর নির্ভরশীল করেছে। এখানে আন্তঃসমাজ বিজ্ঞান কেন্দ্রিক প্রবণতা নেই।
৫) আচরণবাদ তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতায় বিশ্বাসী, কিন্তু সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি তত্ত্ব দর্শনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .