মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কারও মতে, এটি সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া, কেউ বলেন সিপাহি বিদ্রোহ, কেউ বলেন জাতীয় অভ্যুত্থান এবং কারও মতে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলন।
সিপাহি বিদ্রোহ
জন কে. রবার্টস, ম্যালেসন, জন সিলি, জন লরেন্স-এর পাশাপাশি দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ আহমেদ খাঁ, দাদাভাই নৌরজি, রাজনারায়ণ বসুর মতো দেশীয় ব্যক্তিত্বদের মূল্যায়নে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল নিতান্তই সিপাহি বিদ্রোহ। এঁদের মতে, এটি ছিল একদল দেশদ্রোহী ও স্বার্থপর সিপাহিদের বিদ্রোহ।
জাতীয় বিদ্রোহ
অপর একদল ইংরেজ ঐতিহাসিক জে. বি. নর্টন, আলেকজান্ডার ডাফ, হোমস্ প্রমুখ একে জাতীয় বিদ্রোহ বলেছেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের টৌরি দলের সদস্য ডিজরেইলিও মহাবিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ বলে মনে করেন।
সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া
আবার এরিখ স্টোক্স-এর বিচারে এই বিদ্রোহ ছিল একদল গ্রামীণ ভূস্বামীদের স্বার্থরক্ষার সংগঠিত প্রয়াস। রমেশচন্দ্র মজুমদার, জওহরলাল নেহেরু, মার্কসবাদী ঐতিহাসিক রজনীপাম দত্ত প্রমুখের বক্তব্যের মূল কথা ছিল ১৮৫৭ সালের আগের প্রগতিশীলতাকে ধ্বংস করতে এই বিদ্রোহ ছিল রক্ষণশীলতার প্রতিবিপ্লবের প্রচেষ্টা।
প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ
বিনায়ক দামোদর সাভারকর তাঁর ‘Indian War of Independence’ গ্রন্থে বলেছেন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহ ছিল ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ। বিবেকানন্দ ও কার্ল মার্কস এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার তাঁর History of Freedom Movement in India’ গ্রন্থে এই মতের সমালোচনা করে বলেছেন First national war of independence in 1857 is neither first or national nor a war of independence : ড. মজুমদারের মতে, জাতীয়তাবোধ সম্পর্কে তখন সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়নি। এটি সিপাহি বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কিছু নয়। ড. সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর Eighteen Fifty Seven গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহকে স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনোভাবেই বলা যায় না। তবে ড. মজুমদারের বিরোধিতা করে বলেছেন, সামরিক অভ্যুত্থানরূপে শুরু হলেও পরবর্তীকালে তা জাতীয় বিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল।
সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী
সুপ্রকাশ রায়, তলমিজ খালদুন, প্রমোদ সেনগুপ্ত প্রমুখ মহাবিদ্রোহকে ভারতীয় জনগণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম বলে বর্ণনা করেছেন। খালদুনের ভাষায় এটি ছিল “ দেশীয় সামন্ততন্ত্র ও বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কৃষক বিদ্রোহ”।
অন্যদিকে রিস্ এই বিদ্রোহকে ধর্মান্ধ হিন্দু-মুসলমানদের খ্রিস্টধর্ম-বিরোধী জেহাদ বলে বর্ণনা করেছেন।
রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র, রুদ্রাংশ মুখার্জি প্রমুখের বক্তব্যের মূল কথা হল সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছাড়া এই বিদ্রোহ এত বিস্তৃতি ও গুরুত্ব পেত না।
জওহরলাল নেহরু তাঁর Discovery of India গ্রন্থে বলেছেন, এই বিদ্রোহ ছিল প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের। অধ্যাপক সুশোভন সরকার এই বিদ্রোহকে সামস্ততান্ত্রিক ও প্রতিক্রিয়াশীল বলতে রাজি নন। বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা ই. এম. এস. নাম্বুদ্রিপাদ তাঁর A History of Freedom Struggle গ্রন্থে এই বিদ্রোহকে সামরিক অভ্যুত্থান বলেছেন।
সবশেষে আমরা বলতে পারি যে, একশো বছরের ইংরেজ শাসনে মানুষ যে অতিষ্ঠ। হয়ে উঠেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেদিন থেকে এই বিদ্রোহ জাতীয় চরিত্র লাভ করেছিল এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে মুক্তিচেতনা যে জাগরিত হয়েছিল তা সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে জানতে পারা যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .