জলদূষণ
জলদূষণ কাকে বলে? প্রকৃতি প্রদত্ত বিশুদ্ধ জলে নানাধরনের অবাঞ্ছিত বস্তু বা জীবাণু মিশে তা ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে ওঠাকে জলদূষণ বলা হয়।
জলদূষণের কারণ
জলের দ্রবণীয়তা ধর্মের জন্য জলে অনেক গ্যাস এবং কঠিন পদার্থ দ্রবণীয় অবস্থায় থেকে যায়। এ ছাড়া কাপড় কাচা, বাসন মাজা, নোংরা পরিষ্কার করা, সেচের কাজ এবং কলকারখানায় ব্যবহারের ফলে জলে নানারকম নোংরা ও বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়। যুগ যুগ ধরে মানুষ তার নিজের বর্জ্য পদার্থ, জীবজন্তুর মৃতদেহ, বিষাক্ত পদার্থ ইত্যাদি ফেলবার জন্য নদী কিংবা খালের জলকে ব্যবহার করেছে। এর পরিণামে জল দূষিত হয়ে জলদূষণ ঘটছে।
■ [১] জলদূষণের কারণ
নানান কারণে জলদূষণ হতে পারে, যেমন
(১) নগর সভ্যতার ক্রমবিকাশ ও শিল্পোন্নতিই হল জলদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। এর ফলে কলকারখানা ও আধুনিক শিল্পনগরীগুলি থেকে বহু দুষিত রাসায়নিক পদার্থ যেমন : ফেনল, অ্যামোনিয়া, ফ্লোরিন, অ্যালকালাইন, সায়ানাইড, আর্সেনিক, পারদ, তামা, সিসা প্রভৃতি অহরহ নালা-নর্দমা দিয়ে নদী এবং সমুদ্রের জলে মিশে জলকে দূষিত করছে।
(২) কোনো কোনো শিল্প কারখানা, বিশেষ করে ধাতব শিল্প ও পারমাণবিক শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র থেকে অত্যন্ত গরম জল নদীতে ফেলে দেওয়ার জন্য জল দূষণ ঘটে।
(৩) নদীর দুপাশে এবং সমুদ্রের ধারে অবস্থিত শহর ও নগরের স্নানাগার, শৌচাগার এবং ঘরবাড়ির ব্যবহৃত নোংরা জল নদী এবং সমুদ্রের জলে অনবরত দূষণ ঘটাচ্ছে।
(8) আজকাল কৃষিকাজে রাসায়নিক সার ও বিষাক্ত কীটনাশক, ছত্রাকনাশক ও আগাছানাশক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এইসব রাসায়নিক আবার বৃষ্টির জলে ধুয়ে এসে পুকুর ও নদীতে পড়ে জলদূষণ ঘটায়।
(৫) আধুনিক ফিশারী বা মৎস্যচাষে মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য নানারকম রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করা হয়। এরফলেও জল দূষিত হয়।
(৬) ব্যবহার্য পুকুর ও দিঘির জলে গবাদি পশুর স্নান, হাঁসের চাষ, রোগীর মলমূত্রযুক্ত জামাকাপড় ধোয়া এবং সাবান দিয়ে কাপড়চোপড় কাচার ফলে জল দূষিত হয়ে যায়।
(৭) অনেক সময় মৃত জীবজন্তু, এমনকি মানুষের মৃতদেহও নদী নালার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। এতে নদী ও সমুদ্রের জল দূষিত হয়।
(৮) সমুদ্রের জল দূষণের একটি বড়ো কারণ হল তৈলবাহী জাহাজ। তৈলবাহী জাহাজ থেকে যে তেল সমুদ্রে পড়ে তা সমুদ্রের জলে দূষণ সৃষ্টি করে।
(৯) সমুদ্রের উপকূলবর্তী অঞ্চলে আধুনিক ট্রলারের দ্বারা অবৈজ্ঞানিকভাবে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী শিকারের ফলেও সমুদ্রে দূষণ বৃদ্ধি পায়।
(১০) নদী ও সমুদ্রকে আধুনিক সভ্যতা এক মহা ডাস্টবিন হিসেব ব্যবহার করছে। ফলে সমুদ্রে বসবাসকারী বিচিত্র উদ্ভিদ ও প্রাণীগোষ্ঠীর কাছে তা চরম অভিশাপ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। একইভাবে আমরা আমাদের দেশের প্রিয় নদী গঙ্গাকে এক মহা নর্দমায় পরিণত করেছি।
■ [২] জলে আর্সেনিক ও ফ্লুরাইডের উপস্থিতি ও তার ফল
(ক) আর্সেনিক দূষণ
আর্সেনিক হল একরকম মারাত্মক বিষ। পারদের তুলনায় এই বিষ চারগুণ শক্তিশালী। আর্সেনিকের বিষক্রিয়ার ফলে আমাদের ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র এবং রক্তনালীতে নানারকম অস্বাভাবিকতা দেখা যায়। হাতের চেটো এবং পায়ের পাতার তলায় কালো পচনশীল ক্ষত সৃষ্টি হতে থাকে, একে ব্ল্যাকফুট রোগ বলে। এছাড়া আর্সেনিকের প্রভাবে শ্বাসনালির ক্ষতি, যকৃতের পচন, ত্বকের ক্যান্সার, মূত্রথলির ক্যান্সার প্রভৃতি রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মাটির নীচের স্তর থেকে অনিয়ন্ত্রিতভাবে জল তুলে নেওয়ার ফলে মাটির নীচে যে ফাঁকা জায়গা তৈরি হচ্ছে, সেখানে নানারকমের আর্সেনিক ও ক্লোরাইড যৌগ বাতাসের সংস্পর্শে এসে অন্যান্য যৌগে পরিণত হয়। ওই যৌগগুলি অনেক ক্ষেত্রেই জলে দ্রবণীয় এবং নলকূপের জলের মাধ্যমে ওই বিষাক্ত যৌগ আমাদের পানীয় জলে এসে মিশে যায়।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, নদীয়া, হুগলি, হাওড়া, মালদহ এবং বর্ধমান জেলার ৩৭টিরও বেশি ব্লকের ৩,৪০০ বর্গ কিলোমিটারের বেশি অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ জলে বেশি মাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। এই মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা নির্ধারিত নিরাপদ পরিমাণের তুলনায় অনেক বেশি।
(খ) ফ্লুরাইড দূষণ
ফুরিন হল সবুজাভ হলদে রঙের একরকম বিষাক্ত গ্যাস, যা জলে মিশে থাকা সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সোডিয়াম ফ্লুরাইড ও পটাসিয়াম ফ্লুরাইড তৈরি করে। আর্সেনিকের মতো ফ্লুরাইড ও একটি তীব্র ক্ষতিকারক গ্যাসীয় পদার্থ। জলের মধ্যে দ্রবীভূত ফ্লুরাইড থেকে মানবদেহে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফ্লুরাইড প্রথমে মানুষের শ্লেষ্মাঝিল্লি আক্রমণ করে। মানবদেহে ক্রমাগত ফ্লুরাইড প্রবেশ করলে ফ্লুরোসিস রোগ দেখা দেয়। এই রোগে দাঁত ও হাড়ের নানান গঠনগত সমস্যা সৃষ্টি হয়। ওই রোগে আক্রান্ত মানুষ ক্রমশ পঙ্গু হয়ে যায়। হাড়ের ও দাঁতের ক্যালসিয়ামের সঙ্গে ফ্লোরিনের বিক্রিয়ার ফলে হাড় ও দাঁত দুর্বল হয়ে যায়।
এই রোগকে নক্ নি সিনড্রোম নামেও অভিহিত করা হয়। ফসফেট সার, প্লাস্টিক, কাচ শিল্প, ক্লোরিন যুক্ত যৌগ ব্যবহার হয় এরকম সব কারখানা থেকে নির্গত ফ্লোরিনের যৌগ দ্বারা
জল দূষিত হতে পারে।
জলদূষণ প্রতিরোধের উপায়
(১) পুর এলাকার নোংরা ও বর্জ্য মিশ্রিত জলকে পরিশোধিত করার পর নদী অথবা সমুদ্রে ফেলা, তা পরিষ্কার করা অথবা আবার ব্যবহারের উপযোগী করা উচিত।
(২) কলকারখানার নোংরা জলকে পরিশোধিত করে নদীনালায় ফেলা অথবা আবার ওই জলকে কারখানার কাজে ব্যবহার করা প্রয়োজন।
(৩) প্লাস্টিক, মৃতদেহ, কঠিন বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি নদীতে বা জলাশয়ে ফেলা উচিত নয়।
(৪) জলের অপব্যবহার এবং অপচয় যথাসাধ্য বন্ধ করা দরকার।
(৫) কৃষি জমিতে দেওয়া রাসায়নিক সার বা কীটনাশক যাতে সংলগ্ন জলাভূমিকে দূষিত না করে, সেদিকে লক্ষ রাখা উচিত।
(৬) বড়ো জলাশয়, নদী ইত্যাদিতে কাপড় না কাচা, সাবান না মাখা এবং গোরু-মোষ স্নান না করানো উচিত।
(৭) জাহাজ থেকে যাতে তেল নির্গত হয়ে সমুদ্রে না পড়ে, সেদিকে দৃষ্টি রাখা উচিত।
(৮) মল, মূত্র ও হাসপাতালের দূষিত জীবাণুযুক্ত আবর্জনা জলে ফেলা উচিত নয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .