প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল
সূচনা
বিশ্বব্যাপী দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরের সামরিক শক্তি পরীক্ষার সূচনা হল ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ জুলাই। ইউরোপীয় দেশগুলির মধ্যে এই যুদ্ধের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এর উত্তাপ ও উত্তেজনা থেকে বিশ্বের কোনো দেশই রেহাই পায়নি। এর ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে ১১ নভেম্বর পর্যন্ত। ভৌগোলিক ব্যাপ্তির দিক থেকে এই যুদ্ধ যেমন বিশ্বযুত্বের অভিধা লাভ করেছে, অন্যদিকে এত ব্যাপক, সর্বনাশা, সর্বাত্মক যুদ্ধ এক নজিরবিহীন ঘটনা।
সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ
সংকীর্ণ ও স্বার্থপর জাতীয়তাবাদের প্রকাশ দেখা যায়, যখন জার্মান সম্রাট কাইজার দ্বিতীয় উইলিয়াম জার্মানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। জার্মানির বিশ্বরাজনীতিতে অংশগ্রহণ, উপনিবেশ বিস্তার, নৌশক্তি বৃদ্ধি ইউরোপের বহু রাষ্ট্রের ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে বিংশ শতকের প্রথম দশকে ইউরোপ দুটি পরস্পরবিরোধী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে ত্রিশক্তি মৈত্রী, অন্যদিকে ত্রিশক্তি আঁতাত।
সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষা
মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের মতে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রধান কারণ হল সাম্রাজ্যবাদী লালসা। ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলি সাম্রাজ্য বিস্তারের নগ্ন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। এ ব্যাপারে বিজয়স্তম্ভের শীর্ষে ছিল ইংল্যান্ড। তাই জার্মানি দেখল বিশ্বের কাঁচামাল ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ মৃগয়া ক্ষেত্রগুলি ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্সের অধিকারে। জার্মানি সেই সাম্রাজ্যের অধিকার দাবি করলে সমস্ত্র ইউরোপ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে।
যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ
আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই হোক বা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের খাতিরেই হোক, দুটি শিবিরই সমরসজ্জায় সজ্জিত হতে থাকে। সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি, যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র প্রচুর পরিমাণে তৈরি হতে থাকে। আর শিল্পপতিরা যুদ্ধাস্ত্র তৈরি করা লাভজনক ব্যাবসা মনে করে যুদ্ধের আবহাওয়া সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
রুশ-জার্মান যুদ্ধ
সেরাজেভোর হত্যাকাণ্ডে সার্বিয়াকে দায়ী করা হলে এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক বৈঠকে আলোচনা করার প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। কিন্তু জার্মানি এ ব্যাপারে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ মেনে নেয়নি। ফলে শুরু হয় রুশ-জার্মান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ধীরে ধীরে ইটালি, চিন, জাপান ও আমেরিকা মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। তুরস্ক, বুলগেরিয়া জার্মানির পক্ষে যোগ দিলে এই যুদ্ধ বিশ্বযুদ্ধের আকার নেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ
অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফার্দিনান্দ সস্ত্রীক বসনিয়া ভ্রমণ করতে এলে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ২৮ জুন Black Hand নামে একটি সন্ত্রাসবাদী দলের এক আততায়ী বসনিয়ার রাজধানী সেরাজেভোর প্রকাশ্য রাস্তায় ফার্দিনান্দকে সস্ত্রীক হত্যা করে। আততায়ী ও তার সহকর্মীরা অস্ট্রিয়ার প্রজা হলেও জাতিতে ছিল স্লাভ। এই অজুহাতে স্লাভ অধ্যুষিত সার্বিয়াকে দায়ী করে অস্ট্রিয়া কতকগুলি দাবি জানিয়ে এক চরম পত্র পাঠায়। সার্বিয়া প্রায় সমস্ত দাবি মেনে নিলেও সার্বভৌমিকতা ক্ষুণ্ন হওয়ার কারণে কয়েকটি শর্ত মেনে নেয়নি। ফলে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে অস্ট্রিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করলে তা বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল
এই সর্বগ্রাসী যুদ্ধে ১০ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় ২০ মিলিয়ন মানুষ। যুদ্ধের ব্যয়ভার ছিল অপরিসীম। ফলে বিশ্ব অর্থনীতি এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বস্ত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এই যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী ফল হল আন্তর্জাতিকতাবাদের জন্ম। প্রয়োজনের তাগিদে, ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সূত্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, বিশ্ব রাষ্ট্রসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
উপসংহার
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বযুদ্ধের ফলে মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের লালসার আগুনে ইউরোপের আকাশ-বাতাস যখন পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠেছিল তখন সেরাজেভোর মতো একটি ক্ষুদ্র ঘটনা, আপাতশান্তির আড়াল থেকে যুদ্ধদানবের সংহার মূর্তি নিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সেই মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞে মানুষের মূল্যবোধ ও শুভবুদ্ধি হারিয়ে গেল। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে জমে উঠল বিভীষিকার কালো মেঘ।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .