ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষের কারণ
জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে কংগ্রেসের শ্লথগতি, ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাঁদের ধ্যান ধারণা, অনুনয় বিনয়ের রাজনীতি, এদেশের একদল মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি ফলে জাতীয় কংগ্রেসে ফাটল দেখা দেয়। সেই ফাটল থেকেই বিদ্রোহের যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসে তা থেকে জন্ম নেয় সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদ বা চরমপন্থী মতবাদ।
নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অসারতা
জাতীয় কংগ্রেসে নরমপন্থী আন্দোলন কংগ্রেসের তরুণ সম্প্রদায়ের মন জয় করতে পারেনি। আন্দোলনের দাবিদাওয়া সরকারি ঔদাসীন্যে ঢাকা পড়ে যেত। নরমপন্থীদের আবেদন নিবেদনের রাজনীতি দেশের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারেনি। ফলে জাতীয় কংগ্রেসে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের বিভেদ প্রকট হয়ে ওঠে।
অর্থনৈতিক কারণ
ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর ওপর অকথ্য অত্যাচার, শোষণ, অত্যাধিক কর আরোপ, দেশীয় শিল্পের ধ্বংস সাধন করে। এর ফলে কর্মহীন ভারতীয়রা এক কঠিন আর্থিক দুরাবস্থার সম্মুখীন। এছাড়াও এসময় দুর্ভিক্ষ, প্লেগ, মহামারি, ভূমিকম্প, প্রভৃতি প্রাকৃতিক কারণে ভারতবাসীর অর্থনৈতিক দুরবস্থা চরমে ওঠে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের উদাসীনতা ও নিপীড়ন ভারতীয় জনমানসে ব্রিটিশের প্রতি ক্ষোভের সঞ্চার করে।
ভারতীয় মনীষী
স্বামী বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ মনীষীদের বিপ্লবী চেতনা যুবসমাজকে এক নবীন মন্ত্রে দীক্ষিত করে তোলে। এদের বাণী এবং লেখায় জনসাধারণের মধ্যে দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের প্রেরণা সঞ্চার করে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর “আনন্দমঠ” গ্রন্থে দেশ
মাতৃকার সেবায় নিয়োজিত করা আহ্বান জানান।
স্বৈরাচারী শাসন ও বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়া
লর্ড কার্জনের স্বৈরাচারী শাসন, জাতীয়তাবাদকে বিকশিত করতে সাহায্য করে। কাউন্সিল আইন, কর্পোরেশন আইন, বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্য মূলক আচরণ প্রভৃতি দেশবাসীকে সংগ্রামের পথে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত সেই সংগ্রামি মনোভাবে মশাল জ্বেলে দেয়। লালা লাজপৎ রায়, বিপিন চন্দ্র পাল। লোকমান্য তিলক, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ চরমপন্থী নেতারা বঙ্গভঙ্গের তীব্র প্রতিবাদে বলিষ্ঠ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন এবং চরমপন্থী আন্দোলনের প্রয়োজনীতা প্রমাণ করেন।
আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি
সমকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ভারতে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের বিকাশে সাহায্য করে। ইটালি-আবিসিনিয়া যুদ্ধ। রুশ-জাপান যুদ্ধ, ভারতীয়দের মনকে গভীরভাবে আন্দোলিত করে। আয়ারল্যান্ড, মিশর, চিন, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের বৈপ্লবিক সংগ্রাম ভারতীয়দের নবচেতনায় উজ্জীবিত করে। ফলে ভারতের রাজনীতির আকাশে সংগ্রামী জাতীয়তাবাদের সূর্যোদয় হয়।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনায় লক্ষ করা যায় যে, ব্রিটিশদের অত্যাচার, লাগামহীন শোষণ, নিষ্ঠুর দমন নীতি, সাধারণ মানুষের প্রতি দুর্বব্যবহার সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদকে জাগরিত করে। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক নীতিই যে ভারতীয়দের আর্থিক দুর্গতির কারণ চরমপন্থী নেতৃবৃন্দ জনসাধারণকে সে কথা বোঝাতে সক্ষম হন। পরিশেষে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা ভারতবাসীর সংগ্রামী মনোভাবকে তীব্রতর করে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .