পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন
পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে : (১) পৃথিবীর বিভিন্ন দিন-রাত্রির হ্রাসবৃদ্ধির জন্য উত্তাপেরও হ্রাস-বৃদ্ধি এবং (২) পৃথিবীর কক্ষতলের সঙ্গে মেরুরেখার 66\frac{1}{2}^{\circ} কৌণিক অবস্থানের জন্য ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে লম্ব ও তির্যকভাবে পতিত সূর্যরশ্মির জন্য উত্তাপের পরিবর্তন প্রধানত এই দুই কারণে পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হয়।
সূর্য যখন পৃথিবীর যে গোলার্ধে অবস্থান করে তখন সেই গোলার্ধে সূর্যরশ্মি অপেক্ষাকৃত লম্বভাবে পড়ে এবং সেখানে দিন বড় ও রাত্রি ছোট হয়। বিপরীত গোলার্ধে তখন সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে এবং সেখানে রাত্রি বড় ও দিন ছোট হয়। এই জন্য লম্বভাবে পতিত রশ্মির তুলনায় তির্যকভাবে পতিত রশ্মিতে উত্তাপের পরিমাণ কম হয়।
দিন যদি বড় হয় এবং সূর্যরশ্মি প্রায় লম্বভাবে পড়ে, তাহলে পৃথিবী দিনের বেলায় যে তাপ গ্রহণ করে, ছোট রাতে সেই তাপ পুরোটা বিকিরণ করতে পারে না। ফলে ঐ স্থানে তাপ সঞ্চিত হয়ে আবহাওয়াকে উষ্ণ করে, এবং তখন সেখানে গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া পরিলক্ষিত হয়। স্বভাবতই যখন যে গোলার্ধে দিন বড় হয় তখন সেই গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল, বিপরীত গোলার্ধে তখন শীতকাল শুরু হয়। এইভাবে পর্যায়ক্রমে পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হয়ে থাকে।
• প্রতি চার মাস অন্তর পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলে এই ঋতুগুলোর কীভাবে সৃষ্টি হয় নীচে তা আলোচনা করা হল :
■ [১] গ্রীষ্মকাল
নিজের কক্ষতলের সঙ্গে 66\frac{1}{2}^{\circ} কোণ করে পৃথিবীর মেরুরেখা তার কক্ষপথ ধরে অবিরাম সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এইভাবে সূর্য প্রদক্ষিণের সময়, ২১শে মার্চের পর থেকে পৃথিবীর উত্তর মেরু ক্রমশ সূর্যের কাছে আসে। এর ফলে উত্তর গোলার্ধের অর্ধেকের বেশি অংশ আলোকিত হয় এবং আলোকিত অংশের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফলে উত্তর গোলার্ধে দিন বড় এবং রাত্রি ছোট হতে থাকে।
দিন বড় হওয়ার দরুন লম্বভাবে পড়া সূর্যকিরণ উত্তর গোলার্ধের ভূ-পৃষ্ঠকে গরম করার প্রচুর সময় পেলেও রাত্রি ছোট হওয়ায় দিনের জমা তাপের খুব অল্প অংশই বিকীর্ণ হওয়ার সুযোগ পায়, ফলে আবহাওয়ায় গ্রীষ্মের প্রখরতা অনুভূত হয়। এই সময় উত্তর গোলার্ধে তাই গ্রীষ্মকাল। দক্ষিণ গোলার্ধে দিন ছোট ও রাত্রি বড় হওয়ায় এবং সূর্যকিরণ তির্যকভাবে পড়ায় এই সময় শীতকাল।
■ [২] শরৎকাল
২১শে জুনের পর থেকে উত্তর-মেরু সূর্য থেকে দূরে সরে যেতে থাকে এবং দক্ষিণ-মেরু ক্রমশ সূর্যের কাছে আসে। ফলে উত্তর গোলার্ধের জায়গাগুলো সূর্যের আলো কম সময় ধরে পেতে থাকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধের জায়গাগুলো আলো বেশি পেতে থাকে। দিনের বেলায় লম্বভাবে পতিত সূর্যকিরণ পৃথিবীর উপরিভাগকে গরম করে তোলে, ঐ তাপ আবার আশপাশের বায়ুস্তরকে উত্তপ্ত করে। কিন্তু ঐ সঞ্চিত তাপ রাত্রিবেলায় পুরোপুরি বিকীর্ণ হওয়ার সুযোগ পায়, ফলে আবহাওয়ায় শীত ও গ্রীষ্মের পরিমাণ সমান থাকে। এই সময় উত্তর গোলার্ধে তাই শরৎকাল বিরাজ করে। দক্ষিণ গোলার্ধে এই সময় বসন্তকাল।
■ [৩] শীতকাল
নিজের কক্ষতলের সঙ্গে 66\frac{1}{2}^{\circ} কোণ করে পৃথিবীর মেরুরেখা তার কক্ষপথ ধরে অবিরাম সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলেছে। এইভাবে সূর্য প্রদক্ষিণের সময় ২৩শে সেপ্টেম্বরের পর থেকে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু ক্রমশ সূর্যের কাছে আসে, আর উত্তর মেরু ক্রমশ দূরে সরে যায়। এই সময় নিরক্ষরেখার দক্ষিণের অংশে সূর্যের আলোর বেশি অংশ লম্বভাবে পড়ে এবং উত্তর দিকে একটু তির্যকভাবে পড়ে। ফলে দক্ষিণ গোলার্ধে দিন বড় আর উত্তর গোলার্ধে দিন ছোট হয়। উত্তর গোলার্ধে দিন ছোট হওয়ায় পৃথিবীপৃষ্ঠ ও বায়ুস্তর অল্পই গরম হওয়ার সুযোগ পায়। রাত্রি বড় হওয়ার দরুন ঐ তাপ আবার পুরোপুরি বিকীর্ণ হয়ে যায়, ফলে বেশ শীত অনুভূত হয়। ২২শে ডিসেম্বরের দেড় মাস আগে থেকে এই শীতকাল শুরু হয় এবং ২২শে ডিসেম্বরের পরে আরও দেড়মাস এই শীতকাল স্থায়ী হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে দিনের ভাগ বড় বলে ঠিক বিপরীত অবস্থা অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের সূচনা হয়।
■ [৪] বসন্তকাল
২২শে ডিসেম্বরের পর থেকে পৃথিবী তার কক্ষপথে চলতে চলতে ২১শে মার্চ তারিখে এমন একটি অবস্থায় আসে যে, পৃথিবীর দুই মেরু সূর্য থেকে সমান দূরে থাকে, আর সূর্যকিরণ নিরক্ষরেখার উপর খাড়াভাবে পড়ে। সূর্যকিরণ খাড়াভাবে পড়ে বলে দিনের বেলায় নিরক্ষরেখার আশ-পাশের অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ এবং ক্রমে বায়ুস্তর গরম হয়ে ওঠে; কিন্তু দিন- রাত্রি সমান বলে রাত্রিবেলায় সূর্যের তাপের অভাবে ঐ তাপ বিকীর্ণ হয়ে যায়। ফলে আবহাওয়ায় গ্রীষ্ম বা শীতের প্রখরতা প্রায় থাকে না বললেই চলে। এই সময়কে উত্তর গোলার্ধে বসন্তকাল বলে। এই সময় দক্ষিণ গোলার্ধে এর ঠিক বিপরীত অবস্থা অর্থাৎ শরৎকাল।
এই চারটি ঋতু ছাড়াও ভারতে বর্ষা ও হেমন্ত নামে আরও দুটি ঋতুর আভাস পাওয়া যায়। ১৫ই জুন থেকে ১৫ই অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এখানে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, তাই এই সময়কে বর্ষাকাল বলে। আবার ১৫ই অক্টোবর থেকে ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই দু’মাসে বৃষ্টি কমে গিয়ে অল্প শীতের ভাব দেখা যায় বলে এই সময়কে হেমন্তকাল বলে। এই সময় ভোরের দিকে শিশির পড়ে।
ঋতুচক্র
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গ্রীষ্ম, শরৎ, শীত ও বসন্ত—এই চারটি ঋতু পরপর চক্রাকারে আবির্ভূত হয়, একেই ঋতুচক্র বলে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .