জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অবদান
ভূমিকা
পরাধীন ভারতে যে সমস্ত মনীষী ভারতীয়দের আর্থিক-সামাজিক দুরবস্থা, রাজনৈতিক নিপীড়ন, শিক্ষাক্ষেত্রে নানাবিধ সীমাবদ্ধতা প্রভৃতি দেখে বিচলিত হয়েছিলেন এবং জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন তথা জাতীয় আন্দোলনে নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি 1865 খ্রিস্টাব্দের ১ জুন হুগলি জেলার বন্দিপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। 1884 খ্রিস্টাব্দে এবং 1886 খ্রিস্টাব্দে যথাক্রমে BA এবং ইংরেজিতে MA পাস করার পর মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন।
1890 খ্রিস্টাব্দে BL পাস করার পর তাঁর কর্মজীবনের ধারা পালটে গিয়েছিল। তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইনক্তরূপে কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁর স্ত্রী হলেন চারুলতা মুখোপাধ্যায় এবং পুত্র সুব্রত মুখোপাধ্যায় ছিলেন প্রথম বায়ুসেনা প্রধান। যে সমস্ত কাজের জন্য সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় স্মরণীয় হয়ে আছেন সেগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ‘ভাগবৎ চতুষ্পাঠী’ ও ‘ডন সোসাইটি’ স্থাপন, ‘ডন পত্রিকা’ প্রকাশ। তিনি যে সমস্ত স্বনামধন্য মহাপুরুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিপিনচন্দ্র পাল, অশ্বিনীকুমার দত্ত, মহেন্দ্রলাল সরকার, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 1948 খ্রিস্টাব্দের 19 এপ্রিল মারা যান।
জাতীয় শিক্ষা আন্দোলন
পরাধীন ভারতীয়দের ন্যায়সংগত অধিকার হতে বর্ণনা, তাদের আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক নিপীড়ন, শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের শিল্প ও কারিগরি প্রশিক্ষণের সীমাবদ্ধতা সহ নানাদিকে ব্যর্থতা দেখে জাতীয় স্বার্থে মনুষ্যত্ত্বের উদ্বোধন ঘটাতে কর্মযোগী, দেশহিতৈষী পুরুষ সতীশচন্দ্র মানুষের কল্যাণে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তিনি দেশবাসীকে স্বদেশমুখী, সার্বভৌম করতে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। তাই তিনি ছিলেন জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম দূত, জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের অন্যতম পথিকৃৎ। পরাধীন ভারতে জাতীয় শিক্ষার রূপরেখা ছিল না, বরং সেখানে ছিল বিদেশি স্বার্থের কারাগারে বন্দি শিক্ষাক্ষেত্রের সীমাবদ্ধতা। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে জাতীয় শিক্ষা চেতনার উন্মেষ ঘটে ও জাতীয় শিক্ষার প্রসার ঘটে।
ভাগবৎ চতুষ্পাঠী ও ডন পত্রিকা প্রকাশনা
জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম দূত স্বাধীনতা সংগ্রামী সতীশচন্দ্র উপলদ্ধি করেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার অসারতা, শিক্ষাক্ষেতে শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা-সহ শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ের সীমাবদ্ধতা, ভারতীয় ঐতিহ্যের দীনতা। তাই তিনি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে ভারতের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাকে কেন্দ্র করে 1895 খ্রিস্টাব্দে গড়ে তুলেছিলেন ‘ভাগবৎ চতুষ্পাঠী। এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ছিলেন দুর্গাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ। গুরু-শিষ্যের আত্মিক কখনে বাঁধা এই প্রতিষ্ঠানে বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত কলেজে প্রবর্তিত পাঠক্রম অনুসরণ করা হত। ফলে এখানে ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি পাঠাবিষয়ের সঙ্গে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান, শিল্প ও কারিগারি বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ভারতীয় শিক্ষা সংস্কৃতির ধারা বহনকারী ‘ভাগবত চতুষ্পাঠীর আদর্শ-উৎকর্ষ-ঐশ্বর্যের নবসজ্জা জনমানসে তুলে ধরতে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 1897 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন ‘ডন পত্রিকা”। এই পত্রিকায় জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে জাতীয়তাবাদের ঐতিহাসিক-অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক প্রভৃতি বিষয়ক এবং প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা প্রভৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ ছাপানো হত। যে সকল বিদংখ শিক্ষাবিদ এবং ভারতীয় শিক্ষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক লেখা দিয়ে এই পত্রিকাতে সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন— যদুনাথ সরকার, মহেন্দ্রলাল সরকার, বিপিনচন্দ্র পাল, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ভগিনী নিবেদিতা, অ্যানি বেসান্ত প্রমুখ।
ডন সোসাইটি
শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম দূত সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় 1902 খ্রিস্টাব্দে বেসরকারি সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ডন সোসাইটি। 1906 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠিত হলে ডন সোসাইটি উত্ত পরিষদের অঙ্গীভূত হয়ে কাজ শুরু করে। ওই ডন সোসাইটিতে স্থান পেয়েছিল ডন পত্রিকা। ‘ভাগবৎ চতুষ্পাঠী-র মুখপত্র ‘ডন পত্রিকা’ ভারতীয় জাতীয়তাবাদকে তুলে ধরতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল। ভারতীয় ধারার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হতে, ভারতীয় প্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে ওই পত্রিকায় ভারতীয় রীতিনীতি সংস্কৃতির কথা প্রকাশিত হত। পরাধীন ভারতের সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় আলোচনা করা হত। এ ছাড়াও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস, শিল্পকলা, স্থাপত্য, নৌবিদ্যা প্রভৃতি সংক্রান্ত প্রবন্ধও প্রকাশিত হত। তাই ডন পত্রিকা সেদিন ডন সোসাইটির কপালে এঁকে দিয়েছিল নতুন তিলক যা উদ্ভাসিত করেছিল নতুন দিগন্ত | জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনে গতি আনতে ডন পত্রিকার অন্তর্গত ছাত্র বিভাগে সমাজতাত্ত্বিক-রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বিষয়, আত্মপ্রতায়, আত্মসত্তা আত্মনিয়্যাণ বোধের পদ্মা প্রভৃতি তুলে ধরা হত।
ডন সোসাইটির কর্মধারা
ডন সোসাইটি ছিল ডন পত্রিকার প্রয়োগ বাচ্চু (Action wing)। এই প্রয়োগ বাছুর প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলি হল –
- শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় চেতনায় উপরখ করে স্বদেশপ্রীতির উত্তরণ ঘটানো ।
- শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তাধারার বিকাশ ঘটিয়ে প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে আলোচনা সভা,সামাজিক, অনুষ্ঠান, প্রবীণদের সঙ্গে নবীন শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকার প্রকৃতির আয়োজন করা।
- সাধারণ মহাবিদ্যালয়ে প্রচলিত প্রথাগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা দূর করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
- দীনেশচন্দ্র সেন, রাসবিহারী ঘোম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রधবাখন উপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি, ভগিনী নিবেদিতা, গুরুদাস বন্দোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজসেবক, জাতীয় শিক্ষার ধারক ও বাহক মনীষীবৃন্দের কাছ থেকে জাতীয়তাবাদের শিক্ষা নেওয়া।
- শিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
উপসংহার
ঊনবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের প্রাঙ্গণ যাঁদের দানে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রীসতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তাঁর জীবনদর্শনের অনুধাবন করলে দেখা যায়, তিনি ছিলেন ত্যাগী যোগী, জাতীয় চেতনায় উদ্ভাসিত মহাকালের যাত্রাপথে চলা এক অনন্যসাধারণ কালজয়ী মহামানব। জাতীয় শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সাধক হিসেবে সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অবদান চিরস্মরণীয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .