ইউরোপে ভারততত্ত্বের সূচনা
অষ্টাদশ শতকের শেষে ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমে ইউরোপীয় মহাদেশে সংস্কৃতচর্চা ও ভারতীয় ঐতিহ্য নিয়ে পণ্ডিত মহলে ভাবনাচিন্তার সূত্রপাত হয়। আনুমানিক 1786 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1801 খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে উপনিষদগুলি সর্বপ্রথম ইউরোপীয় ভাষায় অনুদিত হয়। 1796 খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সরকার প্রাচ্য বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র (Ecole de Langues Orientales Vivantes) স্থাপন করেন। 1814 খ্রিস্টাব্দে College de France-এ সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার জন্য একটি ‘অধ্যাপক’ পদ সৃষ্টি করা হয়। 1818 খ্রিস্টাব্দ থেকে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে অনুরূপ পদ সৃষ্ট হয়।
ইউরোপীয় মহাদেশে জার্মানি হয়ে ওঠে সংস্কৃতচর্চার ও অধ্যাপনার প্রধান পীঠস্থান। 1816 খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ফ্রানৎস বপ (Franz Bopp) উইলিয়াম জোন্সের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সংস্কৃতের সঙ্গে অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাসমূহের, যথাক্রমে লাতিন ও গ্রিক ভাষার সাদৃশ্য খুঁজে পান। এই আবিষ্কারকে কেন্দ্র করে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব (Comparative Philology) একটি বিজ্ঞানের মর্যাদা পায়।
ঊনবিংশ শতকের ইউরোপে ভারততত্ত্বের সূচনা ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হল 1852 থেকে 1875 খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে সংস্কৃত-জার্মান ভাষায় অভিধান রচনা। এই প্রকাণ্ড অভিধান রচনার কৃতিত্ব দেওয়া হয় দুজন জার্মান পণ্ডিতকে, যথাক্রমে রুডলফ রথ (Rudolf Roth) ও অটো ৰোথলিংক (Otto Bohtlingk)-কে। রাশিয়ার রাজকীয় বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির তত্ত্বাবধানে এই কর্মযজ্ঞটি ফলপ্রসূ হয়। এই অভিধানটির নামকরণ করা হয় ‘সেন্ট পিটারসবুর্গ লেক্সিকন (St. Petersburg Lexicon)
মহামতি ম্যাক্স মুলার (Max Müller) সমগ্র প্রাচ্যদেশীয় ধর্মীয় ও দার্শনিক গ্রন্থগুলির এক অনন্যসাধারণ অনুবাদ ও সংকলন করেন যা ‘স্যাক্রেড বুকস্ অব দি ইস্ট’ (Sacred Books of the East) নামে খ্যাত। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত এই ভারতপ্রেমী ও পণ্ডিত প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের স্নেহভাজন ছিলেন। তিনি রাজা রামমোহন রায় ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের জীবনকে কেন্দ্র করে একটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন।
ম্যাক্স মুলারের আরও একটি মৌলিক গ্রন্থ হল ‘ইন্ডিয়া, হোয়াট ইট ক্যান টিচ আস’ (India, What It Can Teach Us)। কথিত আছে যে, বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক শ্যোপেনহাওয়ার (Schopenhauer) উপনিষদের অনুবাদ পড়ে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ‘ঔপনিখত’ (“Oupnikhat”) তাকে জীবনের সারমর্ম বুঝিয়েছিল। ঋগবেদ, উপনিষদ, সংস্কৃতচর্চা ও ভারততত্ত্বের প্রভাব ইংল্যান্ড ও ইউরোপের ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম করে সুদূর আমেরিকা মহাদেশ পাড়ি দেয়। সেখানে এমারসন (Emerson ), থোরো (Thoreau), হুইটম্যান (Whitman) প্রমুখ প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকেরা ভারতীয় ধ্রুপদি ভাবনাকে সাদরে গ্রহণ করেন, যা তাঁদের রচনায় প্রতিফলিত হয়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .