ভারতীয়দের নিজস্ব ইতিহাস
অধুনা পশ্চিমের পণ্ডিত ও ঐতিহাসিকদের মতে ভারতবর্ষের কোনো প্রকৃত ইতিহাস নেই । এই ইতিহাসহীনতার পিছনে তাঁরা যে যুক্তি দিয়েছেন তা হল এই যে, ভারতবর্ষ নামক কোনো দেশের অস্তিত্ব আদপেই ছিল না বা ভারতবর্ষ বলতে যা বোঝায় তা হল বিভিন্ন ছোটো-বড়ো ও মাঝারি রাজ্য/রাষ্ট্রসমূহের সমাহার। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক হেগেল বলেছেন যে, হিন্দু জাতির কোনো ইতিহাস নেই ( The Hindus have no history)।
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক কার্ল মার্কসের বক্তব্য এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ দ্রষ্টব্য — Hindustan is an Italy of Asiatic dimension, the Himalayas for the Alps, the plains of Bengal for the plains of Lombardy, the Deccan for the Apennines and the Isle of Ceylon for the Island of Sicily. There is the same rich variety in the products of the soil and the same dismemberment in political configuration. Just as Italy has from time to time been compressed by the conquerors sword into different national masses, so do we find Hindustan when not under the pressure of the Mohammedan or the Mughal or the British, dissolved into as many independent and conflicting states as it numbered towns or even villages.
মার্কস ভারতবর্ষ সম্পর্কে যথেষ্ট সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও তার আঞ্চলিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন যা একটি সম্পূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ দেশ গঠনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরারা। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন প্রাক ঐক্যবদ্ধ ইতালির রাষ্ট্র হিসেবে কোনো অস্তিত্ব ছিল না, প্রায় সেইরকমভাবেই সঙ্ঘবদ্ধ ভারতবর্ষের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই।
বহিঃশত্রুর আক্রমণজনিত ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্তান বিভিন্ন স্বাধীন ও সংঘাতপূর্ণ এককে বিভক্ত ছিল। হেগেল এবং মার্কসের এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অবশ্য কোনো সারবত্তা নেই, কারণ দু-জনের মধ্যে কেউই ভারতবর্ষে আসেননি। একদা যথেষ্ট পরিমাণ উপাদানের অভাবে ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসকে পুনর্গঠন করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল।
ভারতীয়দের নিজস্ব একটি ইতিহাসচিন্তা ছিল যা পশ্চিমি পণ্ডিত মহলে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করা হত। সংস্কৃত শব্দ ‘ইতিহাস’-এর ব্যাখ্যা করলে তা হয় “ইতি-হা-অস’ বা যেমনটা হয়ে এসেছে। ইতিহাস ও পুরাণ প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল। প্রাচীন শাস্ত্রগুলিতে চারটি যুগের ব্যাখ্যা আছে, যথাক্রমে—ক্রেতা, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি।
এক-একটি যুগ এক-এক মানসিকতার ও মানুষের ব্যবহারের পরিচয় দেয়। যুগগুলির ব্যবধানও কয়েক লক্ষ বছরের এবং তা চক্রবং পরিবর্তন (Cyclic change) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শাস্ত্রমতে আধুনিক কলিযুগ হল অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলার যুগ। মধ্যযুগীয় ইউরোপের ইতিহাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ (Dark Age)-এর সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে, যা অবশ্য বিতর্কের দাবি রাখে। পুরাণগুলি সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার চালচিত্র তুলে ধরে যা অবশ্যই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
হিন্দুদের দুটি বিখ্যাত মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত আর্যজাতির পারম্পরিক দ্বন্দ্ব ও অনার্যদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ইঙ্গিত দেয়। মহাভারত থেকে মূলত আমরা তৎকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, যুদ্ধকৌশল, কূটনীতি, দৌত্য ইত্যাদি সম্বন্ধে জানতে পারি। শ্রীকৃষ্ণ এখানে প্রধান মন্ত্রণাদাতা ও শিষ্টের পালনকর্তা। শাস্ত্রমতে, রাজার প্রধান কর্তব্য প্রজাপালন এবং ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির একজন আদর্শ রাজা।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .