আধুনিক রাষ্ট্রের নাগরিকদের অর্থনৈতিক অধিকার
আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের ব্যক্তিত্ববিকাশের জন্য সমস্ত অধিকারের মধ্যে অর্থনৈতিক অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ছাড়া ব্যক্তির জৈবিক অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়।
অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবনে ন্যূনতম অন্নসংস্থানের নিরাপত্তাকে অর্থনৈতিক অধিকার বলে। সমাজে অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া প্রতিটি নাগরিক পরাধীন জীবনযাপন করতে বাধ্য। এরুপ অবস্থায় ব্যক্তিসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভব নয়। আধুনিক রাষ্ট্রে নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকারকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যথা—
ক) কর্মের অধিকার
নাগরিকের অর্থনৈতিক অধিকারের মধ্যে কর্মের অধিষ্কার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কর্মের অধিকার অনুযায়ী প্রতিটি ব্যক্তি তার যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মে নিযুক্ত হতে পারবে। মানুষ তার আর্থিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য কর্মে নিযুক্ত হয়। রাষ্ট্রের উচিত, প্রতিটি ব্যক্তিকে সামর্থ্য অনুযায়ী কর্মে নিযুক্ত করা। কর্মে নিযুক্ত হলে প্রতিটি ব্যক্তি তার দৈনন্দিন জীবনে একান্ত প্রয়োজনীয় অর্থাদি ও দ্রব্যসামগ্রী অর্জন করতে পারে। কর্মের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসাবে স্বীকৃত হলেও অধিকাংশ রাষ্ট্রে এই অধিকার পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশেই কর্মের অধিকারকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
খ) উপযুক্ত মজুরির অধিকার
শুধুমাত্র কর্মের অধিকার থাকলেই ব্যক্তির অর্থনৈতিক জীবন নিরাপদ হয় না। উপযুক্ত কর্মের জন্য উপযুক্ত মজুরি প্রয়োজন। রাষ্ট্রের উচিত কর্মের যোগ্যতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে মজুরি প্রদান করা। একজন শিক্ষক ও একজন শ্রমিকের মজুরির মধ্যে পার্থক্যের দিকটি বিবেচনা করা প্রয়োজন। অবশ্য নাগরিকের ন্যূনতম মান রক্ষার জন্য প্রতিটি ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট মজুরি প্রদান করা অত্যাবশ্যক।
গ) অবকাশের অধিকার
গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল সুন্দর জীবনযাপনের জন্য অবকাশের অধিকারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মানুষ হল—
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। নিজ প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নতিসাধন করে। কিন্তু মানুষের এই প্রতিভার প্রয়োগের জন্য অবকাশ প্রয়োজন। ব্যক্তি যদি দিবারাত্রি কর্মের মধ্যে আবদ্ধ থাকে, তাহলে তার ব্যক্তিত্ববিকাশ সম্ভব নয়। তাই, আধুনিক যুগে প্রতিটি রাষ্ট্রে নাগরিকের কর্মের সময়সীমাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অবসর বিনোদনের জন্য বিভিন্ন প্রকার চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঘ) প্রতিপালিত হওয়ার অধিকার
প্রতিটি ব্যক্তি কর্মক্ষম অবস্থায় রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব পালন করে; সুতরাং, বার্ধক্য বা অক্ষম অবস্থায় রাষ্ট্রের উচিত প্রতিটি ব্যক্তির ব্যয়ভার বহন করা। সমাজতান্ত্রিক ও জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রে বিমা, স্বাস্থ্যপ্রকল্প, ভাতা ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্র অক্ষম ও বৃদ্ধ ব্যক্তিদের প্রতিপালনের ব্যবস্থা করে।
ব্যক্তির ব্যক্তিত্ববিকাশের জন্য অর্থনৈতিক অধিকার নিঃসন্দেহে প্রয়োজন। কিন্তু সমাজে উৎপাদনের উপকরণের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা থাকলে অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই অধিকাংশ রাষ্ট্রেই অর্থনৈতিক অধিকার বাস্তব রূপ লাভ করেনি। শুধুমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশেই অর্থনৈতিক অধিকারের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .