স্বাধীনতার প্রকারভেদ
ল্যাস্কির মতে, “স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সেই পরিবেশের সযত্ন সংরক্ষণ যেখানে মানুষ তার সত্তাকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করার সুযোগ পায়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী কতকগুলি ব্যাহিক অবস্থা বা সুযোগ-সুবিধার সংরক্ষণের দ্বারা এই পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের সহায়ক এই সুযোগ-সুবিধাগুলোকেই অধিকার বলে। অধিকার গুলির সমন্বিত উপস্থিতির ফলে যে পরিবেশের সৃষ্টি হয় তাই হল স্বাধীনতা । অর্থাৎ অধিকারের দ্বারাই স্বাধীনতার পরিবেশ রচিত হয়। ল্যাস্কির মতানুসারে, ‘স্বাধীনতা হল অধিকারের ফল,” স্বাধীনতা শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বিভিন্ন রূপের উদ্ভব হয়েছে।
১) পৌর স্বাধীনতা
সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সমাজ-জীবনের সুখ-সমৃদ্ধির স্বার্থে কতকগুলি অধিকার অপরিহার্য। এই অধিকারগুলিকে পৌর অধিকার বলে। দৃষ্টান্ত হিসাবে জীবনের অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্মচারণের স্বাধীনতা, বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এই সকল অধিকারের অস্তিত্ব ছাড়া মানুষের সমাজজীবন সার্থক হতে পারে না।
২) রাজনৈতিক স্বাধীনতা
অধিকাংশ দেশে এখন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভূমিকাই প্রধান। জনগণ যাতে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে সহজেই অংশগ্রহণ করতে পারে তার জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধা থাকা দরকার। এই সকল সুযোগ-সুবিধাকেই রাজনৈতিক স্বাধীনতা বলা হয়। উদাহরণ হিসাবে নির্বাচন করা ও নির্বাচিত হওয়ার অধিকার, সরকারি চাকরি লাভের অধিকার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
৩) অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ব্যতীত পৌর ও রাষ্ট্রনৈতিক স্বাধীনতা নিরর্থক হতে বাধ্য। অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারগুলি ভোগ করা যায় না। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা হল অন্যান্য সকল অধিকারের ভিত্তিস্বরূপ। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বলতে কর্মের অধিকার, অবকাশ বিনোদনের অধিকার, অসুস্থ ও অক্ষম অবস্থায় সরকার কর্তৃক প্রতিপালনের অধিকার, বেকার ও অবসরকালীন অবস্থায় ভাতা পাওয়ার অধিকার প্রভৃতি অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাকে বোঝায়।
৪) জাতীয় স্বাধীনতা
স্বাধীন দেশেই কেবল নাগরিকদের সকল প্রকার স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে। জাতীয় স্বাধীনতা ছাড়া অন্যান্য স্বাধীনতার অস্তিত্ব অসম্ভব। জাতীয় স্বাধীনতা বলতে অপর রাষ্ট্রের সর্বপ্রকার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি বোঝায়। ভারত ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
৫) প্রাকৃতিক স্বাধীনতা
রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ যে স্বাধীনতা ভোগ করত তাকে প্রাকৃতিক স্বাধীনতা বলে। প্রাক্ -রাষ্ট্রনৈতিক প্রাকৃতিক অবস্থায় যথেচ্ছ আচরণের মাধ্যমে মানুষ যে অবাধ ক্ষমতা ভোগ করত তাকে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক স্বাধীনতা বলে। রুশো স্বাভাবিক স্বাধীনতার প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকরাও এই স্বাধীনতার কথা বলেন। কিন্তু প্রাকৃতিক স্বাধীনতাকে প্রকৃত স্বাধীনতা বলা যায় না। প্রকৃত স্বাধীনতা রাষ্ট্র কর্তৃক সৃষ্ট ও সংরক্ষিত হয়। প্রাক্-রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থায় প্রকৃত স্বাধীনতার সৃষ্টি হতে পারে না। প্রাকৃতিক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণবিহীন উচ্ছৃঙ্খলতা বা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর।
৬) ব্যক্তিগত স্বাধীনতা
প্রাচীনকালে গ্রিকরা ব্যক্তিগত ও সম্প্রদায়গত স্বাধীনতার ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন। এথেন্সের অধিবাসীরা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বলতে স্বশাসন, প্রাত্যহিক অভাব-অভিযোগ থেকে মুক্তি এবং ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধার স্বার্থে বাহ্যিক আচার-আচরণের উপর নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতিকে বোঝাতেন। এথেন্সবাসীদের সম্প্রদায়গত স্বাধীনতার ধারণা এখনকার জাতীয় স্বাধীনতার ধারণার অনুরূপ ছিল।
৭) আইনসংগত স্বাধীনতা
আইনসংগত স্বাধীনতা বলতে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনের মাধ্যমে স্বীকৃত, সংরক্ষিত ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতাকে বোঝায়। এই স্বাধীনতা সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং সুনিয়ন্ত্রিত। বৃহত্তর স্বার্থে রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে সকলের স্বাধীনতার উপর প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .