সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের আন্দোলন
ভূমিকা
অসহযোগ আন্দোলনের প্রত্যাহারের পর একদিকে রাজনৈতিক দলাদলি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা, স্বরাজ্যদলের গতানুগতিক আন্দোলনের পদ্ধতি প্রভৃতি ঘটনাবলি ভারতীয় জনজীবনে হতাশার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে কংগ্রেসের তরুণ মহলে বামপন্থী চিন্তাধারা প্রভাব বিস্তার করে। জাতীয় রাজনীতির এই হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে ১৯২৭ সালে ভারতবর্ষে সাইমন কমিশনের আগমন ঘটে।
(১) কমিশনের আগমনের কারণ
ভারতবর্ষের প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য সাইমন কমিশন ভারতে আসেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের সংস্কার আইন অনুসারে ১০ বছর পরে একটি আসার কথা ছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনের জন্য টোরি মন্ত্রীসভা আগেভাগে কমিশন পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনবিদ স্যার জন সাইমনের নেতৃত্ব উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ৭ জন সদস্য বিশিষ্ট সাইমন কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু এই কমিশনে কোনও ভারতীয় সদস্য ছিলেন না।
কমিশনের দায়িত্ব
সাইমন কমিশনের বিচার্য বিষয় ছিল তিনটি, যেমন—
- মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার (১৯১৯) আইনের কার্যকারিতা বিচার।
- ভারতীয়দের প্রশাসনিক যোগ্যতার মূল্যায়ন এবং
- ভবিষ্যতের জন্য কতটা শাসন সংস্কার প্রয়োজন তা খতিয়ে দেখা।
(২) ভারতীয় বিক্ষোভ
সাইমন কমিশন পাঠানোর সংবাদ ভারতবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করে, কারণ ভারতীয় জনমত উপেক্ষা করে শুধু মাত্র বিদেশি সদস্যদের নিয়ে গঠিত কমিশনকেভারতবাসীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পাঠানো হয়েছিল। তাই জাতীয় নেতৃবৃন্দ সাইমন কমিশন নিয়োগকে “জাতীয় অপমান” বলে মনে করলেন। ভারতের সবকটি প্রধান রাজনৈতিক দল (যেমন— জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিমলিগ, হিন্দু মহাসভা এবং ভারতের বণিক ফেডারেশন) সাইমন কমিশনকে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে বর্জন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ফেব্রুয়ারি সাইমন কমিশনের সদস্যবৃন্দ সদলবলে বোম্বাই বন্দরে এসে পৌঁছলে ঐ দিন সমগ্র ভারত জুড়ে হরতাল পালিত হয়। কালো পতাকা ও ‘সাইমন ফিরে যাও’(go back Siman) লেখা পোস্টার নিয়ে সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল ও পিকেটিং করা হয়। সাইমন কমিশন বিরোধী এই বিক্ষোভ ক্রমশ ভারতের প্রধান প্রধান শহরে ব্যাপক গণ-আলোড়নের সৃষ্টি করে।
এই ঘটনার জেরে সরকার ক্ষিপ্ত হয়ে সাইমন-কমিশন বিরোধী আন্দোলন দমন করতে উদ্যত হলেন। সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবের লাহোরে এক প্রতিবাদ মিছিল বের হয় (৩০ অক্টোবর ১৯২৮)। এই মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন পাঞ্জাব কেশরী লালা লাজপত রায়। পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি গুরুতরভাবে আহত হন এবং কয়েকদিন পরে ১৭ নভেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌ শহরে জওহরলাল নেহরু, গোবিন্দবল্লভ পন্থ প্রমুখ নেতারা শোভাযাত্রা পরিচালনার সময় পুলিশের হাতে প্রহৄতহন। কলকাতায়সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করেন সুভাষচন্দ্র বসু।
কার্যত কঠোর দমননীতি প্রয়োগ করেও ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে সারা ভারতব্যাপী আন্দোলনের গতিরোধ করা সম্ভব হয় নি।
(৩) সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনের ফলাফল
(১) সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন সারাভারতে উত্তাল আকার ধারন করলেও ব্রিটিশ সরকার এই সবের প্রতিবাদে কোনো কর্ণপাত করে নি। সাইমন-কমিশন যথারীতি দেশব্যাপী সমীক্ষা চালায় এবং দু বছরের মধ্যে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মে মাসে ব্রিটিশ সংসদেতাদের প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয়।
(২) অন্যদিকে সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সাময়িক ঐক্যবোধের সৃষ্টি করে।
(৩) সাইমন কমিশনের বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে সাময়িকভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার অবসান ঘটে এবং ভারতের মৃতপ্রায় আন্দোলন আবার চাঙা হয়ে ওঠে।
(৪) কঠোর সরকারি দমননীতির চাপে ভারতবর্ষে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের পুনরাবির্ভাব হয়।
(৫) সাইমন কমিশনের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার জন্য মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতীয়দের নিয়ে গঠিত একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির রিপোর্ট সাংবিধানিক সংস্কারের বিকল্প প্রতিবেদন পেশ করা হয় যা ‘নেহরু রিপোর্ট’ নামে পরিচিত।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .