জাতীয় কংগ্রেসের কার্যাবলী
ভূমিকা
১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক নতুন যুগের সূচনা করে। প্রতিষ্ঠালগ্নে কোনও আড়ম্বর না থাকলেও পরবর্তী দুই দশকের মধ্যেই এই প্রতিষ্ঠানটি ভারতের রাজনৈতিক পটভূমিকে একটি প্রধান জাতীয়তাবাদী সংগঠনে পরিণত হয়। প্রধানত এই প্রতিষ্ঠানকেই কেন্দ্র করে উত্তরকালে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালিত হতে থাকে।
(১) জাতীয় কংগ্রেসের আদিপর্ব (১৮৮৫-১৯০৫)
১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম ২০ বছরের ইতিহাস আদি পর্বের ইতিহাস নামে পরিচিত। এই সময়ে জাতীয় কংগ্রেস উদারনৈতিক নরমপন্থী নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দাদাভাই নওরোজী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোপালকৃষ্ণ গোখলে প্রমুখ নেতা। তাঁর সাংবিধানিক সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার এবং জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে নানান দাবি উত্থাপিত করেন।
(ক) রাজনৈতিক দাবি
১৮৮৫ থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে কংগ্রেস নেতারা ভারতের শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় বেশিমাত্রায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের বিভিন্ন দাবির মধ্যে ছিল ভারতের শাসন কাঠামোয় দেশীয় প্রতিনিধিদের আরও ক্ষমতা দান, বড়লাটের আইন পরিষদ ও প্রাদেশিক আইন পরিষদগুলোর সম্প্রসারণ, নির্বাচনের মাধ্যমে আইন সভা ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়োগ, প্রভৃতি। ১৯০৫ সালে গোপালকৃষ্ণ গোখেল ও দাদাভাই নওরোজি সরাসরি ভাবে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ধাঁচে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার দাবি করেন। কিন্তু সেই সময় সরকার কংগ্রেসের কোনো দাবিদাওয়াই মেনে নেননি।
(খ) অর্থনৈতিক দাবি
রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার পাশাপাশি জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা অর্থনৈতিক সংস্কারের কথাও তুলে ধরেন। তাঁরা শুল্ক সংরক্ষণের মাধ্যমে ও সরাসরি সরকারি সাহায্যে শিল্পোন্নয়নের দাবি জানাতে থাকেন। এমনকি সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য করভার কমানো, প্রশাসনিক ও সামরিক ব্যয় হ্রাস, কারিগরী শিক্ষা ও শিল্পোন্নতির জন্য ব্যয় নির্ধারণ, অবাধ বাণিজ্যনীতিকে পরিত্যাগ করা প্রভৃতি বিষয়গুলি উল্লেখ করেন। এর সঙ্গে কৃষক সম্প্রদায়ের শোচনীয় অবস্থা দূর করার জন্য ভূমি রাজস্বের হার হ্রাস, কৃষিব্যাঙ্ক ও সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রভৃতি দাবিও জানানো হয়।
(গ) প্রশাসনিক সংস্কারের দাবি
প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে জাতীয় কংগ্রেস সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বেশি সংখ্যক ভারতীয়দের নিয়োগ করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। তাঁদের প্রশাসনিক দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইংল্যান্ডের অনুকরণে ভারতেও আই.সি.এস.পরীক্ষা গ্রহণ, সাধারণ প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, অস্ত্র আইন বাতিল, পুলিশ-প্রশাসনের সংস্কার, জুরি প্রথার প্রসার প্রভৃতি। এছাড়াও তাঁরা সারা ভারতে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, আয়করও লবণ আইনের বোঝা কমানোর দাবি করেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও সরকারের মনোভাব ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক।
(ঘ) অন্যান্য সংস্কারের দাবি
কংগ্রেসের অন্যান্য দাবির মধ্যে ছিল – ভারতবাসীদের গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা, সংবাদ পত্র ও বাক স্বাধীনতার অধিকারের সুরক্ষা প্রভৃতি। এছাড়া ভারতীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য সরকারের কাছে রাখা তাঁদের বিভিন্ন দাবি ছিল: প্রাথমিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রসার প্রভৃতি।
১৯০৫-১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের বয়কট ও স্বদেশি আন্দোলন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ওপর বিশেষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনের ফলে কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে আদর্শগত মতবিরোধ চরম আকার ধারণ করে। এই সময়ে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের পর জাতীয় কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুই গোষ্ঠীত বিভক্ত হয়ে পড়ে। কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাংলার অরবিন্দ ঘোষ ও বিপিনচন্দ্র পাল, মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক, পাঞ্জাবের লালা লাজপত রায় প্রমুখ। কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের মদ্যে আদর্শগত বিরোধ তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের সুরাট অধিবেশনে ওদের বিরোধ চরমে পৌঁছায় এবং কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুইটি গোষ্ঠীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
(২) মূল্যায়ন
প্রথমত
জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের প্রথম কুড়ি বৎসরের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, তাঁরা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। এর জন্য একদিকে যেমন তাঁদের সাংগঠনিক ও অন্যান্য দুর্বলতা ছিল, অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের অনমনীয় মনোভাব তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয়ত
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার আদিপর্বের নেতৃবৃন্দ শুধু সংখ্যালঘু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিরই প্রতিনিধিত্ব করতেন বলে দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁদের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না।
তৃতীয়ত
জাতীয় কংগ্রেসের সূচনা পর্বের নেতাদের মধ্যে সংগ্রামী মনোভাবের চেয়ে ‘আবেদন নিবেদনশীল নীতিতে’ বেশি আস্থাবান ছিলেন। তাই প্রথমত পর্বের নেতাদের কর্মপদ্ধতিকে ভিক্ষুকের রাজনীতি’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়, ‘জয় রাধে কৃষ্ণ, ভিক্ষা দাও গো, ইহাই ইহাদের পলিটিক্স’।
চতুর্থতত
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সূচনা পর্বে কংগ্রেসী নেতাদের গোষ্ঠী স্বার্থ এবং ব্যক্তি প্রাধান্যের প্রবণতা সামগ্রিকভাবে কংগ্রেসকে যথেষ্ট দুর্বল করেছিল। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক অমলেশ ত্রিপাঠী মন্তব্য করেছেন। কংগ্রেসের প্রকৃত ঐক্য যে প্রাদেশিক গোষ্ঠীস্বার্থ বিসর্জন এবং সামগ্রিক স্বার্থনুসরণে, এই বোধ জন্মাতে অনেক দেরি হয়েছে’।
প্রথম যুগের নেতৃবর্গের কর্মপ্রচেষ্টা একেবারে নিষ্ফল ছিল না। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের কুফলগুলি জনসমক্ষে তুলে ধরেন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। তাঁরা ভারতবাসীর জনমত গঠনেও সহায়ক হয়েছিলেন। এই বক্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী যথার্থই বলেছেন, ‘নরমপন্থী নেতারা যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক শোষণের দিকটি তুলে ধরেছিলেন তা শুরু চরমপন্থী নয়, গান্ধিবাদীদের চিন্তাধারারও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .