বিংশ শতকে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভব
ভূমিকা
১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ২০ বছর (১৯০৫ খ্রিঃ) ধরে কংগ্রেসের নেতৃত্বে যে আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে তা নরমপন্থী আন্দোলন নামে পরিচিত। এই সময়ে গোপালকৃষ্ণ গোখলে, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ নরমপন্থী নেতারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে যে, যুক্তিপূর্ণ ‘আবেদন-নিবেদন নীতি’র সাহায্যে তাঁরা ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে নানান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া আদায় করতে পারবেন।
কিন্তু ঊনবিংশ শতকের শেষ ভাগ থেকেই নরমপন্থী আন্দোলনের নানা দুর্বলতা ফুটে উঠতে থাকে। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে অরবিন্দ ঘোষ (পরবর্তীকালে শ্রী অরবিন্দ) সর্বপ্রথম নরমপন্থী কংগ্রেসি আন্দোলনের সমালোচনা করেন। এই ব্যাপারে অরবিন্দের বক্তব্য ছিল
(১) ব্রিটিশদের কাছে দয়া ভিক্ষার মাধ্যমে ‘কিস্তিবন্দি শাসন সংস্কার আদায়’ করে কোনও লাভ হবে না,
(২) এখন থেকে কংগ্রেসি আন্দোলনকে শহরে উচ্চ সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে নিম্নবিত্ত তথা দরিদ্রদের মধ্যেও প্রসারিত করতে হবে।
এই প্রসঙ্গে তিনি আবেদন-নিবেদন নীতি বর্জন করে নিষ্ক্রিয় গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন।
পরবর্তী সময়ে কংগ্রেস নেতা লোকমান্য তিলক অরবিন্দের কথাকেই সমর্থক করে বলেন ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার, ভিক্ষা করে স্বরাজ আদায় করা যায় না, আত্মশক্তি ও আত্মত্যাগের দ্বারাই জাতিকে তা অর্জন করতে হয়।’ লালা লাজপত রায় ও বলেন যে, কংগ্রেসের নরমপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে দেশের জনগণের কোনও মানসিক যোগাযোগ নেই।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের প্রধান কারণ
অধ্যাপক সুমিত সরকারের মতে, নরমপন্থী আন্দোলনের প্রতি সমালোচনামূলক (Critique) দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের তথা চরমপন্থী আন্দোলনের উদ্ভবের প্রধান কারণ।
অন্যান্য কারণ
ওপরের প্রধান কারণটি ছাড়াও : (১) ব্রিটিশ সরকারের বিভিন্ন ধারায় অর্থনৈতিক শোষণ, (২) প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্ভিক্ষ এবং মহামারীর সময় সরকারি উদাসীনতা, (৩) স্বৈরাচারী ও জনবিরোধী সরকারী আইন প্রণয়ন, (৪) বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ মনীষীদের দেশাত্ববোধমূলক রচনা, (৫) জাপানের হাতে রাশিয়ার পরাজয় এবং আয়ারল্যান্ড, রাশিয়া, চিন, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের জনগণের সংগ্রামী কার্যকলাপ এবং (৬) কংগ্রেসের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ক্ষমতা দখলের লড়াই— প্রভৃতি ছিল সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের অন্যান্য কারণ।
এই সমস্ত বিভিন্ন কারণে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেও ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা তাতে ঘৃতাহুতি দেয়। প্রকৃতপক্ষে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বঙ্গভঙ্গ প্রধান না হলেও প্রত্যক্ষ কারণ।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের নীতি
বিংশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতে নরমপন্থী জাতীয়তাবাদের বিকল্প হিসেবে সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের উদ্ভবের যুগে চরমপন্থীরা তিনটি ভিন্ন নীতি বা ধারায় সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন পরিচালনার কথা বলেন যেমন—
(১) আত্মশক্তি বা স্বদেশি আন্দোলন
এই আদর্শ অনুসারে, ভারতের উন্নতির জন্য ব্রিটিশের মুখাপেক্ষী না হয়ে না থেকে আত্মশক্তি দ্বারা জাতি গঠন এবং সয়ম্ভরতার মাধ্যমে দেশগঠনের কথা বলা হয়, (যেমন— জাতীয় শিক্ষার প্রচলন, দেশীয় শিল্প ও কুটির শিল্প গঠন প্রভৃতি)
(২) নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ বা বয়কট আন্দোলন
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের এই নীতি অনুসারে সরকারি অফিস আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিলিতি কাপড় এবং বিলিতি জিনিসপত্র বর্জন অর্থাৎ বয়কট করার কথা বলাহয়।
(৩) বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন
এই নীতি অনুসারে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ও গুপ্ত বিপ্লবী সন্ত্রাস চালিয়ে সরকারি শাসনযন্ত্রকে পঙ্গু করে দেওয়ার কথা বলা হয়।
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের সাফল্য
নানান ত্রুটিবিচ্যুতি এবং ব্যর্থতা স্বত্ত্বেও সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের বহু সাফল্যও ছিল, যেমন—
প্রথমত
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতি স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল।
দ্বিতীয়ত
এই আন্দোলনের প্রভাবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস চরমপন্থী ও নরমপন্থী এই দুই গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যায়।
তৃতীয়ত
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দেয় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি ভারতের বাইরেও ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। এই বিপ্লবী গণেচেতনা পরবর্তীকালে বামপন্থী আন্দোলনের জন্ম দেয়।
চতুর্থত
সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের প্রভাবে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে প্রথম ব্যাপক গণআন্দোলনের সূচনা হয়, যা পরবর্তীকলে গান্ধিজির নেতৃত্বে ভারতব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রচনা করে। এছাড়া কংগ্রেস দলের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতায় সুভাষ চন্দ্র বসু কংগ্রেসের মধ্যেই আপোসহীন রাজনীতি করতে পেরেছিলেন।
সর্বোপরি, সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের একটি বিশেষ ধারার অনুগামীরা বিদেশি শক্তির সাহায্যে ভারতে ব্রিটিশ শাসন অপসারণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জার্মানী ও জাপানের সহযোগিতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের নেতৃত্বে আজাদ হিন্দ ফৌজের সশস্ত্র সংগ্রাম ছিল এই ধারার শেষ সংগ্রাম।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .