পশ্চিমবঙ্গের শিল্পের উন্নতির কারণ
পূর্ব ভারত তথা সমগ্র দেশের অন্যতম শিল্পোন্নত রাজ্য পশ্চিবঙ্গ। ছোটো-বড়ো-মাঝারি তিন ধরনের শিল্পই এই রাজ্যে বিকাশ লাভ করেছে। ভারতের সাতটি বৃহদায়তন লোহা-ইস্পাত কারখানার মধ্যে দুটি এবং তিনটি মিশ্র ইস্পাত কারখানার মধ্যে একটি গড়ে উঠেছে এই রাজ্যে। দেশের সর্বাধিক পাটকল আছে এই রাজ্যেই । চা শিল্পেও পশ্চিমবঙ্গ , দেশের দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। যেসব অনুকূল কারণে পশ্চিমঙ্গে শিল্পের উন্নতি ঘটেছে , সেগুলি হল—
কাঁচামালের প্রাচুর্য
পশ্চিমবঙ্গে যেসব শিল্প গড়ে উঠেছে , তার মধ্যে অধিকাংশেরই কাঁচামাল পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত হয় অথবা এই রাজ্যের কাছাকাছি এলাকা থেকেই আহরিত হয়। যেমন— দুর্গাপুর ও কুলটি-বার্ণপুরে যে লোহা-ইস্পাত কারখানা গড়ে উঠেছে , তার কাঁচামাল কয়লা আসানসোল-রানিগঞ্জ অঞ্চলে পাওয়া যায়। এ ছাড়া কাছাকাছি ছোটোনাগপুর মালভূমি থেকে কয়লা , আকরিক লোহা , চুনাপাথর , ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি অন্যান্য কাঁচামাল সহজেই এখানে আনা যায় । আবার , পশ্চিমবঙ্গের অপর দুই প্রধান শিল্প — চা ও পাট। পাট শিল্পের কাঁচামাল পার্ট সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদিত হয়। আর উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় চা চাষ হয়। সুতরাং চা শিল্পের কাঁচামালও এই রাজ্যেই পাওয়া যায়।
শক্তি সম্পদের সহজলভ্যতা
শিল্পের উন্নতির জন্য শক্তি সম্পদের সহজলভ্যতা অপরিহার্য। পশ্চিমবঙ্গ কয়লা সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ায় শিল্পের প্রয়োজনীয় শক্তি পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। রানিগঞ্জ-আসানসোল অঞ্চলের কয়লা সম্পদের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন স্থানে কয়লা ভিত্তিক অনেকগুলি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ( কোলাঘাট , ব্যান্ডেল , সাওতালডিহি , ফারাক্কা , দুর্গাপুর , টিটাগড় , কাশীপুর , বক্রেশ্বর প্রভৃতি ) নির্মিত হওয়ায় শিল্পের উন্নতিতে বিশেষ সহায়ক হয়েছে।
উন্নত পরিবহণ ব্যবস্থা
কলকারখানা বা শিল্পকেন্দ্রে কাঁচামাল আনা এবং শিল্পজাত দ্রব্য বিক্রয়কেন্দ্রে পাঠানো বা বাজারজাত করার জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা থাকা দরকার। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়কপথ ( 2 নং , 6 নং , 34 নং ইত্যাদি ) এবং পূর্ব , দক্ষিণ পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলপথ পশ্চিবঙ্গের ওপর দিয়ে বিস্তৃত হওয়ায় সমগ্র দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান তথা যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা হয়। এ ছাড়াও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অবস্থানও যোগাযোগের ক্ষেত্রে এত সুবিধা পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের উন্নতিতে অনুকূল প্রভাব ফেলেছে।
কলকাতা-হলদিয়া বন্দর
কলকাতা-হলদিয়ার মতো প্রথম শ্রেণির বন্দর এই রাজ্যে থাকায় দেশ বিদেশের সঙ্গে সুলভ জলপথে বাণিজ্য করা যায়। যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য উপকরণ আমদানি এবং শিল্পজাত পণ্য রপ্তানির এই সহজ সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সুলভ শ্রমিকের প্রাচুর্য
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্যতম জনবহুল রাজ্য এবং সংলগ্ন বিহার , ওডিশা প্রভৃতি রাজ্যও ঘনবসতিপূর্ণ। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের প্রয়োজনীয় সুলভ শ্রমিক সহজেই পাওয়া যায়।
জল সরবরাহ
কলকারখানায় প্রচুর জলের প্রয়োজন। শিল্প শ্রমিকেরও জলের দরকার। পশ্চিমবঙ্গ নদীমাতৃক রাজ্য। গঙ্গা , ভাগীরথী-হুগলি , দামোদর , অজয় , ময়ূরাক্ষী , মহানন্দা , তিস্তা , তোর্সা প্রভৃতি অসংখ্য নদনদী এই রাজ্যের বিভিন্ন অংশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় শিল্পের প্রয়োজনীয় জল পেতে কোনো অসুবিধা হয় না।
শিল্পজাত দ্রব্যের বিপুল চাহিদা
শিল্পের উন্নতি বহুল পরিমাণে শিল্পজাত দ্রব্যের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল। পশ্চিমবঙ্গ তথা পূর্ব ভারত অত্যন্ত জনবহুল হওয়ায় সমগ্র অঞ্চল জুড়ে শিল্পজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা আছে , যা পশ্চিমবঙ্গের শিল্পোন্নয়নে সহায়তা করেছে।
পর্যাপ্ত মূলধন বিনিয়োগ
শিল্পের উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত মূলধন বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়। একসময় ব্রিটিশরা এই রাজ্যের চা শিল্প , পাট শিল্প প্রভৃতি বিভিন্ন শিল্পের উন্নতিতে মূলধন বিনিয়োগ করেছিল। পরবর্তী সময়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার , বিভিন্ন অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি সংস্থা এই রাজ্যে শিল্প স্থাপনে পর্যাপ্ত পরিমাণে মূলধন বিনিয়োগ করেছে।
অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশ
পশ্চিমবঙ্গের বিস্তৃত সমতলভূমি এবং পরিমিত উষ্ণতা ও বৃষ্টিপাত শিল্পের উন্নতির পক্ষে বিশেষ অনুকূল।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
অস্থির রাজনৈতিক অবস্থা শিল্প বিকাশের প্রতিকূল। পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা লক্ষ করা যায় , তা শিল্পের উন্নতির সহায়ক।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .