গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের উত্থান
সূচনা
সুদীর্ঘ ৩০ বছর দরে চিনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ফলশ্রুতি ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব যা চিনে একটি গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনে ৪ মে (১৯১৯ খ্রি.) আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছিল তার ফলেই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের চেয়ারম্যানরূপে মাও-জে-দঙ্ বলেন- আমরা আমাদের নিজস্ব সভ্যতা সৃষ্টির জন্য এবং বিশ্ব শান্তি ও মুক্তির জন্য সাহস ও পরিশ্রমের সঙ্গে কাজ করব।
কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর অসামান্য প্রচেষ্টায় চিনে কমিউনিস্ট দল গড়ে ওঠে (১৯২১ খ্রি. ১ জুলাই) । সাংহাই প্রদেশের ফরাসি অধিকৃত একটি গার্লস্ স্কুলে গোপনে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল। চিনে সমাজতন্ত্র তথা মার্কসীয় দর্শনের আধাররূপে প্রতিষ্ঠিত হয় এই চিনা কমিউনিস্ট পার্টি। পিকিং, চাওঁসা, ক্যান্টন প্রভৃতি জায়গায় এই কমিউনিস্ট পার্টির শাখা গড়ে ওঠে। এই চিনা কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন ভেন-তু-শিউ। চিনা কমিউনিস্ট পার্টিত্র মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাও-জে-দঙ্, লিও-শাও-চি, চৌ-এন-লাই, চু-তে প্রমুখ। চিনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠায় মোট ১২ জন বুদ্ধিজীবীর অবদান ছিল। মার্কসবাদ জনপ্রিয় করার কাজে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন অধ্যাপক চেন-তু-শিউ এবং অধ্যাপক লি-তাও-চাও।
লঙ্ মার্চ
রাষ্ট্রিপতি চিয়াং-কাই-শেক ছিলেন প্রচণ্ড কমিউনিস্ট বিদ্বেষী। চিনা কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য তিনি তাদের প্রধান ঘাঁটি কিয়াং-সি অভিমুখে সেনাবাহিনী পাঠান (১৯৩৪ খ্রি.)। এদিকে ওই সময় জাপান মাঞ্চুরিয়া দখল করে উত্তর দিনে হোইলি পর্যন্ত ঢুকে পড়ে। কিন্তু চিয়াং জাপানের এই আগ্রাসনের কোনো প্রতিকার না করে কমিউনিস্ট নিধনে অধিকতর সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এই কারণে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই প্রায় এক লক্ষ চিনা কমিউনিস্ট তাদের পরিবার পরিজনসহ কিয়াং-সি ত্যাগ করে উত্তর দিনে পীত নদীর বাঁকে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ শেন স প্রদেশ অভিমুকে দীর্ঘ পদযাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ এই পদযাত্রায় কমিউনিস্টরা ৬০০০ মাইল পথ অতিক্রম করেছিল। তারা এসময় সাধারণ মানুষের আন্তরিক সহানুভূতি ও সাহায্য লাভ করে।
সিয়াং ফু ঘটনা
মাও-জে-দঙের নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা উত্তর চিনের শেন-সি প্রদেশে একটি প্রায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, যার রাজধানী ছিল সিয়াং-ফু। কমিউনিস্টদের দমনের জন্য প্রজাতন্ত্রী চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই-শেক সেখানে একদল সেনা পাঠান (১৯৩৫ খ্রি.) । ওইসব চিনা সৈন্য কমিউনিস্টদের দমনের পরিবর্তে সমর্থন করতে শুরু করে। এই সংবাদে বিচলিত চিয়াং নিজে সিয়াং-ফুতে উপস্থিত হন। তখন তাঁরই এক সেনাপতি চ্যাং শিউ-লিয়াং হঠাৎ চিয়াংকে বন্দি করে এক অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে রাখে। প্রায় দু-সপ্তাহ বন্দি থাকার পর সোভিয়েত হস্তক্ষেপে এভং চৌ-এন-লাই এর মধ্যস্থতায় চিয়াং মুক্তি পান।
কুয়োমিনটাং দলের কমিউনিস্ট বিরোধিতা
মাও-জে-দঙ্ ছিলেন চিনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান। অন্যদিকে কুয়োমিনটাং দলের প্রধান ও চিনা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি মার্শাল চিয়াং-কাই-শেক ছিলেন কট্টর কমিউনিস্ট বিরোধী। মাও-জে-দঙ্ কিয়াং সি অঞ্চলে কৃষকদের নিয়ে গড়ে তোলেন লাল ফৌজ (১৯২৮ খ্রি.)। চিয়াং-কাই-শেখ এই লাল ফৌজকে ধ্বংস করার জন্য সেনাবাহিনী পাঠালে চিনে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
কমিউনিস্ট শক্তিবৃদ্ধি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত জাপান ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মসমর্পণ করে। এরপর কুয়োমিনটাং ও চিনা কমিউনিস্টদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আবার চরমে ওঠে। কিন্তু নানা কারণে কুয়োমিনটাং দলের সামরিক শক্তি ক্রমহ্রাসমান। পক্ষান্তরে কমিউনিস্টরা ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে চিনের কৃষক ও শ্রমিকশ্রেণির সমর্থন লাভ করে।
কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রজাতন্ত্র গঠন
ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন ও সামরিক শক্তির সহায়তায় মাও-এর নেতৃত্বে চিনা কমিউনিস্টরা একের এক চিনের বিভিন্ন ভূখন্ড দখল করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত চিয়াং সরকারকে যুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করে কমিউনিস্টরা পিকিং দখল করে। মূল ভূখন্ড থেকে উচ্ছেদ হয়ে চিয়াং কাই শেখ ফরমোজা (তাইওয়ান) দ্বীপে আশ্রয় নেন। সেখানে কুয়োমিনটাংরা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে। আর চিনের মূল ভূখন্ডে মাও জে দঙের নেতৃত্বে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দ ১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’ বা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী চিন’ নামে খ্যাত। মাও-জে-দঙ্ হন এর রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হন চৌ-এন-লাই।
কমিউনিস্টদের সাফল্যের কারণ
চিনের কমিউনিস্টরা সফল হয়েছিল বেশ কিছু কারণে-
1. মাও-জে-দঙের নেতৃত্ব
মাও-জে-দঙের অসামান্য নেতৃত্বে চিন কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা ও প্রসার ঘটেছিল। নেতারূপে তাঁর দক্ষতা, সংগঠকরূপে তাঁর সাংগঠনিক বুদ্ধি ও শক্তি, সেনাপতিরূপে তাঁর রণকৌশল কমিউনিস্ট দলকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছিল।
2. জনসমর্থন
মাও-এর ডাকে সাড়া দিয়ে চিনবাসী যে-কোনো আত্মত্যাগে তৈরি ছিল। কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছিল মাওয়ের কমিউনিস্ট দল। স্বাভাবিকভাবে তাই চিনে কমিউনিস্ট আন্দোলন সফল হয়েছিল ও গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গড়ে উঠেছিল।
3. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে চিনের জনবিরোধী ও দুর্ণীতিপ্রবণ কুয়োমিনটাং দলকে সমর্থন করেছিল, এতে চিনবাসী আরও বেশি করে কমিউনিস্ট সমর্থক হয়ে পড়ে।
4. সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য
সাম্যবাদের আঁতুড়ঘর সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম থেকেই চাইত যে বিশ্বে সাম্যবাদী ভাবধারার প্রসার ঘটুক। সোভিয়েত নেতাদের ধারণা ছিল পুঁজিবাদের প্রসার রোধ করতে সাম্যবাদের বিস্তার প্রয়োজন। তাই চিনের সাংহাই নাগরীতে যখন মাও-জে-দঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হল (১৯২১ থ্রি.) তখন সবার আগে সোভিয়েত রাশিয়া এই দলকে সমর্থন করেছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার পরামর্শ মেনে চিনের কমিউনিস্ট দল শ্রমিকশ্রেণিকে তাদের আন্দোলনে শামিল করেছিল। তাই চিনের কমিউনিস্ট দলের প্রতিষ্ঠা থেকে উত্থান পর্যন্ত সোভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় সহযোগিতা ছিল বলা চলে।
উপসংহার
মাও-জে-দঙের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট দল চিনে যে গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল তা চিনকে বিশ্বের এক নয়া শক্তিরূপে পরিচিত দিয়েছিল। দীর্ঘ ৩০ বছরের সংগ্রামের ফসলকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্ট দল চিনে আধুনিকীকরণের পটভূমি গড়ে তুলেছিল। কমিউনিস্ট চিনের প্রতিষ্ঠা দিবসে (১৯৪৯ খ্রি. ১ অক্টোবর) মাও-জে-দঙ্ এক ভাষনে বলেন, চিনবাসী আর কখনও দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হবে না বা তারা কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপও মেনে নেবে না। A Concise History of China’ গ্রন্থে বলা হয়েছে – এটি চিনের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল, যে যুগের ইতিহাস ছিল চিনা জনগণতন্ত্রের অধীনে সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রগতির ইতিহাস।
Leave a reply
You must login or register to add a new comment .